কলঙ্কভাগী
সৈকত মুখোপাধ্যায়
ফুলকি একরকম দৌড়তে দৌড়তেই জবাপিসির রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, জবাপিসি দরজার দিকে পেছন ফিরে, পিঁড়ির ওপর বসে কী যেন একটা বাটনা বাটছে। জবাপিসির শরীরের পেছনদিকটা দেখে ফুলকি কিছুক্ষণের জন্যে ভুলেই গেল, সে কী বলতে এসেছিল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ভাবল—কী সুন্দর পিসির কোমরটা, কি গভীর পিঠের খাঁজ! একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবল, আমার যে কবে অমন হবে!
দেরি আছে, ফুলকি জানে। যদিও তার বয়স তেরো, কিন্তু এখনও সে ঋতুমতি হয়নি। শরীরটা তার একটু বেটাছেলে মার্কা, হাড়সার। স্বভাবটাও তাই—যাকে বলে গেছো মেয়ে। সারাদিন বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুটন্ধু বেশি নেই।
জবা নিশ্চয়ই ফুলকির পায়ের আওয়াজ পেয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাই দরজার দিকে তাকাল। হলুদমাখা হাতের উলটোপিঠ দিয়ে কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে জিগ্যেস করল, কী রে হাঁপাচ্ছিস কেন?
জবাপিসির মুখের দিকে তাকিয়ে ফুলকি আবার ভুলে গেল, সে কী বলতে এসেছিল। পিসির মুখটা কি সুন্দর! ছোট্ট পানপাতার মতন মুখ। চোখের পাতা বকনা-বাছুরের চোখের পাতার মতন ঘন। ঠোঁট দেখলে মনে হয় যেন বিষপিঁপড়ে কামড়িয়েছে। ফুলকি আবার একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবল, আমার যদি অমন লাল-লাল, ফোলা-ফোলা ঠোঁট হত!
তারমধ্যেই ফুলকি একবার চট করে দেখে নিল, জবাপিসির কপালে গুঁড়ি গুঁড়ি ঘাম জমে আছে। যদিও ফাল্গুনের হাওয়াতে এখন এতটুকু তাপ নেই।
আগের দিন দুপুরেই মা, চন্দনাকাকি, বিনতাকাকি, ওরা ফুলকিদের পেছনের ঘরে বসে ন'তাসের বিন্তি খেলতে খেলতে জবাপিসির শরীরের অত্যধিক ঘাম নিয়ে কথা বলছিল আর হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। ফুলকি আড়ি পেতে শুনছিল। পুরোটা বুঝতে পারেনি, তবে মনে হয়েছিল বিয়ের পরে বর-বউ যে অসভ্যতা করে, তার সঙ্গে ঘামের সম্বন্ধ রয়েছে। বিনতাকাকি একবার বলল, অমন একটা সোমত্থ মেয়ের শরীরের গর্মি,কুঠে প্রদীপের সাধ্য কী ঠান্ডা করে।
'কুঠে প্রদীপ' কথাটা সেদিনই প্রথম শুনল ফুলকি। শুনে একটু চমকে উঠল। সত্যিই কি প্রদীপপিসের কুষ্ঠ হয়েছে নাকি? দেখে তো সেরকম মনে হয় না। কুষ্ঠরুগি অনেক দেখেছে ফুলকি। তারা মঙ্গলাকালীর মন্দিরের সিঁড়ির নীচে বসে থাকে, ন্যাকড়া-জড়ানো হাত বাড়িয়ে ভিক্ষে চায়। তাদের বোঁচা নাক, চোখের পাতা নেই। প্রদীপপিসের তো দিব্যি মোটাসোটা ফর্সা তেল-চুকচুকে চেহারা। তবে হ্যাঁ! ইদানিং ওনার নাকের পাটাটা কেমন যেন ফোলা ফোলা লাগে। ফোলা আর লালচে।
বিনতাকাকির বাকি কথাগুলো, মানে ওই শরীরের গর্মি, ঠান্ডা করা, ওসবের মানে বেশ বুঝতে পেরেছিল ফুলকি। বুঝতে পেরে তার মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল। সে তখন বইয়ের দিকে মুখটা ঝুঁকিয়ে প্রাণপণে পড়ায় মন ফেরানোর চেষ্টা করেছিল।
জবাপিসি আবার তাড়া লাগাল—কী রে ফুলকি? ওরকম হাঁদার মতন মুখের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? কিছু বলবি?
ফুলকির মনে পড়ে গেল, সে কী বলতে এসেছিল। তাড়াহুড়ো করে বলল, পিসি, দেখে যাও একবার।
কোথায় যাব?
পেছনের বাগানে। চলো না! দেখে চমকে যাবে।
জ্বালাতে পারিস, সত্যি! জবার ঠোঁটদুটো নীচের দিকে বেঁকে গেল।
জবা জানে, ফুলকি মেয়েটা এরকমই। সারাক্ষণ বনে-বাদাড়ে একা একা ঘুরে বেড়ায়। কোথায় কোন পাখির বাসা, কোথায় মৌচাক, কোথায় কুঁচফল, নোনা আতা—সব নখদর্পণে। মেয়েটা গাছপালা পাখি পোকামাকড় এইসব ভালোবাসে। জবাদের বাগানেই সারাদিন আপনমনে ঘুরে বেড়ায় আর থেকে থেকে জবার রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। ডাক দেয়, পিসি! তোমাদের বাথরুমের ঘুলঘুলিতে দোয়েল পাখি বাসা বেঁধেছে দেখেছ? পিসি! মাটি ফুঁড়ে কেমন নাগচম্পার ফুল ফুটেছে দেখে যাও।
যদিও জবার শরীরে-মনে অনেক জ্বালা, যদিও জবার মেজাজ সারাক্ষণ তিরিক্ষে হয়ে থাকে, তবু সে এই তেরো বছরের বাচ্চা মেয়েটার ওপর রাগতে পারে না। ক্যাটক্যাট করে কথা শোনায় বটে, তবে আবার ওর ডাকে সাড়া দিয়ে এটা ওটা দেখতেও যায়। ভাবে, আর ক'টা দিন? আর একটু বড় হয়ে গেলেই তো বেচারার জঙ্গলে বেড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ঘটির জলে হাত ধুয়ে নিয়ে জবা উঠে দাঁড়াল। রান্নাঘরের দরজায় শেকল তুলে, আঁচলে হাত মুছে বলল, চল তাড়াতাড়ি। বাবুর ফেরার সময় হয়ে গেছে। তার জন্যে এখন পিন্ডি রাঁধতে হবে।
অন্য সব বাড়ির চেয়ে এ-বাড়িতে রান্নাবান্না হয় দেরিতে। তার কারণও আছে। প্রদীপ দত্ত হাটতলার দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরেন দুপুর আড়াইটেয়। তারপর কর্তাগিন্নির স্নান-খাওয়া। জবার বাচ্চাকাচ্চাও নেই যে, তাদের জন্যে তাড়াতাড়ি রাঁধতে হবে।
ফুলকি জবাপিসির হাতে টান দিয়ে দাওয়া থেকে নেমে বাগানের রাস্তা ধরল।
দত্তবাড়ির বাগানের রাস্তায় দুপুরের রোদে ভাপ উঠছে। সেই ভাপের সঙ্গে মিশে গেছে পুটুশপাতার ঝিমধরানো গন্ধ। গাছগাছালির নীচে ধর্ষণচিহ্নের মতন আলোছায়ার ছেঁড়া অন্তর্বাস। ফুলকি চলল বাড়ির পেছনের দিকে, যেদিকে বেড়ার ওপাশে বাঁশবাগান আর পোস্তপানায় ছাওয়া সবুজ ডোবা। ফুলকির পেছন পেছন জবাও চলল। তার পায়ে গোলাপি প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। ফুলকির মনে হল, এখনো যেন দুধে আলতার ছোপ লেগে রয়েছে জবাপিসির ফর্সা পায়ের পাতায়, যদিও ওদের বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় তিনবছর হল।
চালতাগাছের পাতার আড়াল থেকে একটা বেনে বউ ডেকে উঠল—খোকা হোক। খোকা হোক। চলা থামিয়ে জবাপিসি ঘেন্নার চোখে পাখিটার দিকে তাকাল। পাখিটা একটা বড়সড় সবুজ শুঁয়োপোকা তার কমলারঙের দুই ঠোঁটের মধ্যে টিপে ধরে উড়ে চলে গেল পাটোয়ার-বাগানের দিকে।
জবাপিসিকে সঙ্গে নিয়ে ফুলকি থামল গিয়ে একেবারে প্রদীপপিসের পুজোর ঘরের জানলার নীচে জড়ো করে রাখা ইটের পাঁজাটার কাছে। তারপর উবু হয়ে বসে পড়ল।
জবা অবাক গলায় বলল, কী আছে ওখানে? নোংরা কিছু নয় তো? আমার কিন্তু চান হয়ে গেছে।
ফুলকি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় জবাপিসিকে তার পাশে বসতে বলল। জবা বসল। তখন ফুলকি আঙুল দিয়ে ইটের পাঁজার ভেতরে একটা খোঁদলের দিকে দেখাল। জবা দেখল, শ্যাওলা জমা মাটির ওপরে লেবুর আচারের মতন দেখতে দশ-বারোটা ডিম।
কিসের ডিম রে? ফিসফিস করে জিগ্যেস করল জবা।
গোখরোর। ফুলকিও ফিসফিস করে উত্তর দিল। আমি কদিন ধরেই মা-সাপটাকে এখানে ঢোকা-বেরোনো করতে দেখছি। আজ একটু আগে বেরিয়ে যেতেই আমি তোমাকে ডাকতে দৌড়েছি।
কিছুক্ষণ মুগ্ধদৃষ্টিতে ডিমগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে জবা নিজের মনেই বলল, কী সুন্দর না ফুলকি?
সুন্দর! ফুলকি একটু চিন্তা করল। জবাপিসি ওই ডিমগুলোর মধ্যে সৌন্দর্য কোথায় খুঁজে পেল? একটু পরে জবা বলল, আমার গা শিরশির করছে। মা-টা যদি ফিরে আসে। চল পালাই।
পিসি! ফেরার পথে ফুলকি ডাকল।
বল!
তুমি এবার কী করবে? মুনিষকে বলবে নাকি পাঁজাটা ভেঙে ডিমগুলো নষ্ট করে ফেলতে?
সে কথার জবাব না দিয়ে জবা উলটে ফুলকিকে প্রশ্ন করল, তুই তো সারাক্ষণ জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরিস। বলতে পারিস, গোখরোর বাচ্চাদের বিষ থাকে কি না?
থাকে না? ফুলকি ঘুরে দাঁড়াল। জবার চোখে চোখ রেখে বলল, মায়ের যতটা বিষ থাকে ছায়েরও ঠিক ততটাই থাকে। একবার ছুবলে দিলেই...ফুলকি ওপর দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে এতটা জিভ বার করল।
কী খায় ওরা?
ডেঁয়ো পিপড়ে খায় পিসি। সত্যি। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
পিসি!
ডাক শুনে জবা চমকে তাকায়। দেখে, তাকে রান্নাঘরে দেখতে না পেয়ে ফুলকি এখানে চলে এসেছে...এই ঠাকুরঘরে।
কী করছ গো পিসি? ফুলকি পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকে আসে। হঠাৎ জবা প্রচণ্ড খেপে ওঠে। চিৎকার করে বলে, মুখপুড়ি মেয়ে! আদাড়-বাদাড় ঘুরে বাসি কাপড়ে ঠাকুরঘরে ঢুকে এলি যে? বেরো, বেরো বলছি এক্ষুনি।
ফুলকি এতদিন জবাপিসির পায়ে পায়ে ঘুরছে এরকম ব্যবহার পিসির কাছ থেকে সে কোনোদিন পায়নি। সে দত্তবাড়ি থেকে বেরিয়ে, পায়ে পায়ে নিজের বাড়িতে ফিরে চলল। তার কান্না পাচ্ছিল খুব, কিন্তু কাঁদতে পারছিল না। কান্নাকে ছাপিয়ে অন্য একটা অনুভূতি তার বুকের ভেতরে পাক খেয়ে উঠছিল। তার নাম বিস্ময়।
ফুলকি বিস্মিত, কারণ, ওই এক লহমার মধ্যেই সে দেখে নিয়েছিল জবাপিসি ঠাকুরঘরে কী করছিল। পুজো করছিল না জবাপিসি। পিসের পুজোর জোগাড়ও করছিল না। জবাপিসি বাগানের দিকের জানলা থেকে ঠাকুরের আসন অবধি মুঠোয় করে বাতাসার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
কেন?
দুদিন আগে ইটের পাঁজার ভেতরে গোখরোর ডিম ফুটেছে। ফুলকি জবাপিসিকে সঙ্গে করে দেখিয়ে এনেছিল ডিমের চুপসে যাওয়া ছেঁড়া খোসাগুলো। বাচ্চাগুলোকে কোথাও দেখতে পায়নি। সেটাই স্বাভাবিক। সাপের বাচ্চারা একজায়গায় থাকে না, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জবাপিসি জিগ্যেস করছিল, ছানাগুলো কোথায় গেল রে ফুলকি?
ফুলকি বলেছিল, শুকনো বাঁশপাতার নীচে লুকিয়ে আছে মনে হয়। ইটের পাঁজার আড়ালেও কয়েকটা থাকতে পারে।
ঘরে ঢুকবে না তো?
ফুলকি বলেছিল, কেন ঢুকবে? তোমার ঘরে কি ওদের খাবার আছে?
সেদিন ছিল না। আজ ফুলকি দেখে এল—আছে। পিসের ঠাকুরের আসনের চারপাশে বাতাসার টুকরোর ওপরে থিকথিক করছে ডেঁয়োপিপড়ের দঙ্গল। ওরাই তো গোখরোর বাচ্চার খাবার।
জবাপিসি বাতাসার টুকরো ছড়িয়ে ওদের বাগান থেকে ডেকে এনেছে! কেন? পিসি কী বুঝতে পারছে না, এতে বিপদ বাড়ছে? ডেঁয়োপিপড়ের পেছন পেছন সাপের বাচ্চাগুলোও ঘরের মধ্যে চলে আসতে পারে।
ফুলকি তারপর থেকে বেশ কয়েকদিন অভিমানে জবাপিসির কাছে যায়নি, কথাও বলেনি। কিন্তু কতদিন না গিয়ে থাকবে? ওইখানেই তো যত সাপ, বড় বড় মাকড়শা, গিরগিটি। ওই বাড়িতেই তো জবাপিসি, যার শীতকালেও ব্লাউজের বগল ঘেমে ওঠে। প্রদীপপিসে, যার নাকটা তো ফুলে উঠছে বটেই, ইদানিং গায়ে ফোসকাও বেরোচ্ছে।
একদিন তাসের আড্ডায় চন্দনাকাকিমা বলল, কী সর্বনেশে কথা মা? বেশ্যাবাড়ি থেকে রোগ ধরিয়ে আনবে, আর সেই রোগ ঢুকিয়ে দেবে বউটার শরীরে?
মা বলল, মেরে পুঁতে ফেলতে হয় এইসব বেটাছেলেদের। ঘেন্না, ঘেন্না! জবাটার জন্যে ভয়ে আমার প্রাণটা শুকিয়ে যায় দিদি।
বিনতাকাকিমা বলল, ওষুধ নেই নাকি মাইমা ওই অসুখের।
রসের দিদা পরপর মাদুরের ওপর চিড়েতনের টেক্কা আর ডাবরে পানের পিচ ফেলে বললেন, কলকাতায় খিদিরপুরে জাহাজঘাটার কাছে থাকতাম তো। ওখানে এই প্রমেহ রোগের বাড়বাড়ন্ত খুব। বলে, মাসিক শুরু হয়নি এমন মেয়ের সঙ্গে শুলে নাকি ও রোগ সেরে যায়।
অন্য তিনজন চোখ কপালে তুলে বলল, মরণদশা। ঝাঁটা মারি।
মাসখানেকের মধ্যে সাপের বাচ্চাগুলো ফুলকির চোখের সামনেই বেশ বড় হয়ে গেল। জবাপিসিদের বাগানে খুব বেশি হলে দশমিনিট খোঁজাখুঁজি করলেই তাদের একটাকে না একটাকে দেখতে পায় ফুলকি। ইটের পাঁজার আড়াল থেকে, নাহয় বাঁশপাতার নীচ থেকে তারা জুলজুলে চোখ মেলে ফুলকির দিকে তাকিয়ে থাকে। সড়াৎ সড়াৎ করে চেরা জিভ মুখের মধ্যে ঢোকায় আর বার করে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, জবাপিসির হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও পিসের পুজোর ঘরে একটাও ঢুকল না। ছানাগুলো পিঁপড়ে ছেড়ে ব্যাং খাবার মতন বড় হয়ে গেল।
একদিন, তখন ফুলকির স্কুলে গরমের ছুটি, পিসি তাকে ডেকে বলল, ফুলকি, তোর চান হয়ে গেছে?
ফুলকি বলল, হ্যাঁ।
তাহলে টগরগাছ থেকে ক'টা ফুল তুলে তোর পিসেমশাইয়ের ঠাকুরের আসনে সাজিয়ে দিয়ে আয় তো।
এসব মেয়েলি কাজ ফুলকির খুব একটা পছন্দ নয়, তবু জবাপিসির কথা ফেলতে পারে না। সে টিউবওয়েলের জলে হাত ধুয়ে ফুল তোলে। তারপর ফুলের সাজি নিয়ে ঠাকুরঘরে ঢোকে। পিসে আসনে বসে চন্দনপিড়িতে চন্দন ঘষছিল। চমকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, কী রে ফুলকি, তুই যে ফুল নিয়ে এলি?
ফুলকি বলল, পিসি বলল।
প্রদীপপিসে বললেন, ও, তোর পিসির বুঝি শরীর খারাপ? তারপর কিছুক্ষণ কেমন একভাবে ফুলকির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, তোর শরীর খারাপ হয়নি তো?
ফুলকি নিজেকে নিষ্কলুষ প্রমাণ করার তাগিদে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, না। আমার এখনো হয় না।
বেশ! ওঁ বিষু, ওঁ বিষু, ওঁ বিষু! ওঁ তদবিষ্ণো পরমন্তপ সদা পশ্যন্তি সূরয়ম...আয় ফুলকি, এইখানে আমার পাশটাতে বোস।
দরজার বাইরে থেকে জবাপিসি খর-গলায় ডাক দেয়—ফুলকি! এক্ষুনি উঠে আয়!
সেদিন সকাল থেকে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছিল। রাস্তাগুলো হয়ে গিয়েছিল নদী। ফুলকি যে ফুলকি, জঙ্গলচড়ুনি মেয়ে, তারও বাইরে বেরোতে মন সরছিল না। কিন্তু আবার না বেরোলেও নয়। সবেমাত্র দুদিন আগেই সে দেখে এসেছে, প্রদীপপিসের বাড়ির পেছনের ডোবার পাড়ে, হোগলাঝোপের মধ্যে ডাহুকপাখি ডিম পেড়েছে। নীল মার্বেলের মতন চারটে ডিম।
ওদিকে আবার গোখরোর বাচ্চাগুলোও সারাদিন খাই খাই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত বাগানে বেজি থাকে, তক্ষক থাকে। তারা সাপ মেরে খায়। সন্ধেবেলায় ভুতুম-পেঁচা এসে বসে গাছের ডালে। নিস্তব্ধ দুপুরে সাপমার চিল ঝোপেঝাড়ে মুখ ঢুকিয়ে সাপ খোঁজে। দত্তবাড়ির বাগানে কিছুই নেই। তাই বাচ্চাগুলোর খুব বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। ডাহুকের ডিমগুলো সাপের পেটে গেল কিনা, সেটা না দেখে স্বস্তি পাচ্ছিল না ফুলকি।
দুপুরের দিকে বৃষ্টিটা একটু সময়ের জন্যে বন্ধ হতেই তাই সে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ল। চলে গেল সোজা দত্তদের বাগানে।
প্রদীপপিসে এই বর্ষার শুরুতে মাঝে মাঝেই বাড়িতে থাকেন না। বাবার কাছে ফুলকি শুনেছে পাটের আড়তদারেরা এই সময়ে নদিয়ার রানাঘাটের দিকে চাষিদের কাছে পাটের দাদন দিতে চলে যায়। আজকেও পিসে বাড়িতে নেই।
সেটা একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ইদানিং জবাপিসি সব বিষয়েই ভীষণ উদাসীন থাকলেও প্রদীপপিসের হয়েছে ঠিক উলটো। তিনি বাড়িতে থাকলে ফুলকির পক্ষে বাগানে ঢোকাই হয়ে যায় দায়। পিসে যেন ফুলকির গায়ের গন্ধ পান। ঠিক কোত্থেকে এসে গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়াবেন। ফিসফিস করে ভালো ভালো কথা বলবেন। ফুলকির ভালোও লাগে, আবার কেমন যেন অস্বস্তিও লাগে পিসে কাছে এসে দাঁড়ালে।
সেদিন ফুলকি ডোবার পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখল অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্য। জল থইথই ডোবার পাড়ে মা ডাহুকের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারটে খুদে খুদে বাচ্চা। চারিদিকের অঢেল পোকামাকড় গিলে তারা যেন মাঝের এই একদিনেই বেশ বড় হয়ে গেছে। ফুলকির ভীষণ ইচ্ছে হল একবার জবাপিসিকে দৃশ্যটা দেখায়। সে সাবধানে জবাপিসির ঘরের বাগানমুখী জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, জানলাটা বন্ধ। এইসময়ে জানলা বন্ধ কেন? পিসি কি ঘুমোচ্ছে?
মাটিতে পড়ে থাকা একটা তালের গুঁড়ির ওপরে উঠে ফুলকি ছিটকিনির ফুটোয় চোখ লাগিয়েই জমে পাথর হয়ে গেল। বিছানার ওপরে পিসি আর একটা লোক জড়ামড়ি করে ঘুমোচ্ছে। কারুর গায়ে একটা সুতো অবধি নেই।
ফুলকির নাককান দিয়ে আগুন বেরোচ্ছিল। গলার মধ্যে ঘুড়ির মাঞ্জার মতন খরখরে আর চটচটে একটা কিছু ডেলা পাকিয়ে উঠছিল। সে কতক্ষণ যে ওইভাবে দাঁড়িয়েছিল তা সে নিজেই জানে না।
সেদিন কখন যে ফুলকি তার বিছানায় এসে লক্ষ্মীমেয়ের মতন শুয়ে পড়েছিল তা কেউ খেয়াল করেনি। তবে বিকেলের দিকে তার মা মেয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখল, বেশ জ্বর। জ্বরের ঘোরেই ফুলকি শুনতে পেল দত্তদের বাগানে একটা লোককে সাপে কেটেছে। লোকটা নাকি এ গ্রামের লোকই নয়। জবাপিসির বাপের বাড়ির দিকে তার বাড়ি। মাঝে মাঝে চাকরির খোঁজে প্রদীপপিসের কাছে তদ্বির করতে আসত।
শুনল, লোকটাকে না কামড়ালে সাপটা প্রদীপপিসেকেই কামড়াত। কারণ, লোকটা যেখানে মরে পড়েছিল, প্রদীপপিসে বাগানের সেই অন্ধকার রাস্তা ধরেই বাড়ি ফিরছিলেন। পড়ে থাকা লোকটার গায়ে হোঁচট খেয়ে তিনিই নাকি চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করেন।
সবাই বলাবলি করছিল, প্রদীপ খুব জোর বেঁচে গেছে। ওই জবার গ্রামের লোকটা নিজে মরে প্রদীপকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। ফুলকি তাই শুনে লুকিয়ে লুকিয়ে দু-হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল।
তিনদিন বাদে জ্বর সারার পর ফুলকি শুনল প্রদীপপিসে সাপের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে একটা ময়ূর কিনেছেন। আর যায় কোথায়? মা পেছন থেকে ডাক দিয়ে তাকে আটকাবার অনেকরকম চেষ্টা করল, কিন্তু ফুলকি কারুর কথা শুনলে তো? সে তক্ষুনি ছুটল দত্তদের বাগানে ময়ূর দেখতে।
ফুলকি দেখল, তিনদিনেই বাগানের চেহারা অনেক বদলে গেছে। প্রদীপপিসে বাড়ি ফিরে সব বদলিয়ে দিয়েছেন। ঝোপঝাড় সব সাফ। বাগান ঘিরে নতুন বাঁশের বেড়া আর একদিকে ময়ূরের জন্যে খড়ের চালাঘর। পুরোনো ইটের পাঁজার চিহ্নও কোথাও নেই।
তবে সে তো শুধু বাগানটুকু। তার বাইরে বাকি গ্রামটা একইরকম রয়েছে। সেই ঘন বাঁশঝাড়। জমে থাকা শুকনো পাতার স্তূপ। ফুলকি ওখানে দাঁড়িয়েই শুনতে পেল ডোবার পূবদিক থেকে কেঁয়াও কেঁয়াও করে একটা কোলাব্যাঙের করুণ ডাক। জঙ্গলচরা মেয়ে ফুলকি জানে, বেচারা ব্যাঙটা সাপের মুখে ধরা পড়েছে। যতক্ষণ ধরে সাপটা ওকে গিলবে, ততক্ষণই ব্যাঙটা ওইভাবে ডেকে যাবে।
হঠাৎ একটা তীক্ষ্ন ডাকে চমকে উঠে ফুলকি দেখল কুন্দফুলের ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে প্রদীপপিসের নতুন ময়ূর। ময়ূরটা একবার মাত্র গলা তুলে ফুলকিকে দেখল, তারপর তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে গেল যেদিকে মাটির গামলায় জল রাখা আছে, সেইদিকে।
ফুলকির কিন্তু ময়ূরের দিক থেকে আর চোখ সরে না। কী সুন্দর... কী সুন্দর ওই পাখি! পাখি বলে মনেই হয় না, মনে হয় রূপকথার কোনো জীব। অভ্র, জরি, রাংতা—পৃথিবীর যত কিছু ভালো ভালো জিনিস দিয়ে যেন ভগবান সেই ময়ূরকে গড়েছেন। কী গর্বিত তার চলাফেরার ভঙ্গি, ঘাড় তুলে তাকানো! কী ভয়ঙ্কর সুন্দর তার ডাক। তার গলার নীলে যেন মেঘের নীল এসে মিশেছে। তার চোখের নীচে সাদা কাজলের টান যেন কথাকলি নর্তকের মতন রহস্যে ভরা। হলুদ ঠোঁটে দুনিয়ার অবজ্ঞা।
দিন পনেরোর মধ্যে গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েরা ময়ূর সম্বন্ধে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। শুধু ফুলকির ঘোর আর কাটে না। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটুর ওপরে থুতনি রেখে ময়ূর দেখে।
কখনো কখনো জবাপিসিও বাগানে আসে। জবাপিসিকে দেখলে আজকাল বড় ভয় করে ফুলকির। চোখ দিয়ে সারাক্ষণ যেন আগুন ছুটছে। চোখের তলায় কালি। গালের হাড় উঁচু হয়ে উঠেছে। জবাপিসি আজকাল আঁচল দিয়ে সারাক্ষণ বুক কোমর ভালো করে ঢেকেঢুকে ঘোরে। কারণটা ফুলকি জানে। প্রদীপপিসে জবাপিসিকে আজকাল খুব পেটায়। বাগানে বসেই ফুলকি শুনতে পায় প্রদীপপিসের গালাগাল। সব কথার অর্থ বুঝতে পারে না। হারামজাদি যেমন চেনা শব্দ, কিন্তু খানকি মাগি মানে কী? আর গালাগালের সঙ্গেই শুরু হয় মার। একটা কথা ফুলকি স্বীকার করে। জবাপিসি যেরকম মুখে টুঁ শব্দ না করে মার খেতে পারে, তেমনটা কোনো হালের বলদও পারে না।
জবাপিসিকে মার খেতে দেখলে খুব একটা দুঃখ হয় না ফুলকির। তার মাথার মধ্যে বারবার ফিরে আসে সেই দুপুরের ল্যাংটো ছবিটা। দাঁতে দাঁত চিপে ফুলকি আস্তে আস্তে বলে—মার খাওয়াই উচিত খানকি মাগির। মানে না জানলেও গালাগালটা বেশ জুতসই লাগে ফুলকির।
জবাপিসি বাগানে এলে ফুলকি অন্যদিকে তাকিয়ে বসে থাকে। কেউ কারুর দিকে তাকায় না। দুজনেই ময়ূর দেখে। ময়ূর প্রথম প্রথম ওদের কাউকেই দেখত না, নিজের মনে মাটি ঠুকরে বেড়াত। তারপর কিছুদিন সে দুজনকেই দেখত। কী তীব্র সেই চাউনি। যেন বুকের ভেতর অবধি দেখে নিচ্ছে। এক পা, দু-পা করে কাছে এগিয়ে এসে,পা থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে দৃষ্টিকে ওপরদিকে তুলত। ফুলকি স্কার্ট দিয়ে নিজের হাঁটু ঢাকতে ঢাকতে আড়চোখে চেয়ে দেখত, জবাপিসিও আঁচল দিয়ে বুক ঢাকছে।
ময়ূরটা প্রবলভাবে পুরুষ। এবং এমন পুরুষ যার পাশে নারী নেই...ময়ূরী নেই।
তারপর সেই দিনটা এল। সেটাও ছিল দুপুরবেলা। সেদিনও মেঘ করেছিল খুব। ময়ূরটা তার কিছুক্ষণ আগেই একটা সাপ মেরেছিল। সেটাকে কিছুটা খেয়ে, কিছুটা ছড়িয়ে, ফিরে এল সেই নারকেল গুঁড়িটার কাছে, যেখানে ফুলকি বসেছিল।
ফুলকির একদম কাছে এসে দাঁড়াল ময়ূরটা। গলা বাড়িয়ে দিল ফুলকির দিকে। এই প্রথম ময়ূরটার মসৃণ নরম পেশী দিয়ে গড়া নলের মতন গলায় হাত বুলিয়ে দিল ফুলকি। এরকম কোনো অঙ্গে এর আগে হাত দেয়নি ফুলকি। তার গাটা শিরশির করে উঠল। ময়ূরটা একপা দু-পা করে একটু পিছিয়ে গেল, কিন্তু একবারের জন্যেও ফুলকির চোখ থেকে চোখ সরাল না।
ফুলকি চোখের কোনা দিয়ে দেখল, তাদের উলটোদিকে, কিছুটা দূরে, জবাপিসি এসে দাঁড়িয়েছে।
তারপর মেঘ ডেকে উঠল। এমন আশ্চর্য মেঘের ডাক আগে কখনো শোনেনি ফুলকি। মেঘ ডাকল যেন তার বুকের অনেক ভেতরে। যেন ফুলকির অনেকজন্ম আগেকার চাপা পড়ে থাকা সব কষ্ট সেই মেঘগর্জনের সঙ্গে ওপরে ভেসে উঠল আর সেই গর্জন মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ময়ূরটা আকাশের দিকে মুখ তুলে তীব্র আশ্লেষে ডেকে উঠল—ক্রেয়াও ক্রেয়াও ক্রেয়াও।
তারপর শুরু হল তার নাচ। ঝলমলে পেখম মেলে, ঘুরে ফিরে সে কী আনন্দে উদ্বেল নাচ তার। ময়ূর নাচ দেখাচ্ছে ফুলকিকে। ময়ূরটা ফুলকিকে নাচ দেখিয়ে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে। ফুলকির মনের মধ্যে কি যে হচ্ছিল তা সে বোঝাতে পারবে না। যেন পৃথিবীর শেষ রাজা তার মনোরঞ্জনের জন্যে তার সামনে নতজানু হয়ে ভিক্ষা করছেন। ফুলকিরবুকের ভেতরে মুহুর্মুহু বিশাল সব উল্কা খসে পড়ছিল, আবার সেই সব উল্কার আঘাতে তৈরি সাগরপ্রমাণ গহ্বর মুহূর্তের মধ্যে ভরে উঠছিল প্লাবনের জলে।
মেঘের ডাকে কোনো যতি ছিল না, যতি ছিল না বৃষ্টির। যতি ছিল না সেই ময়ূরের প্রণয় নৃত্যে। বৃষ্টির জল ফুলকির গাল গলা মুখ ভাসিয়ে দিয়ে, হু-হু করে নেমে যাচ্ছিল তার সদ্য প্রস্ফুটিত দুই স্তনের মাঝখান দিয়ে আরো নীচে। হঠাৎ...হঠাৎই একটা বড়সড় ঢিল উড়ে এল ময়ূরটার দিকে। ময়ূরটার গায়ে না লাগলেও সে নাচ থামিয়ে গম্ভীরভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল নারকোলগাছের সারির ওইদিকে। ফুলকি দেখল, জবাপিসির চোখ থেকে আগুন ঝরছে।
তারপর থেকে ময়ূরটাকে নিয়ে হল ফুলকির জ্বালা। সে যখন-তখন ফুলকির ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে ডাক দেয়। বলে, ফুলকি! একবার বাইরে এসো। দেখো, চারিদিকে কেমন আমন মরশুম। খেতে-খেতে ফনফন করে বেড়ে উঠছে কোটি কোটি ধানগাছ। কত সঙ্গম ঘটছে চারিদিকে, কত জন্ম। বৃষ্টিথামা বিকেলবেলায় আকন্দঝোপের মাথায় হাজার হাজার লাল ফড়িং-এর ওড়াউড়ি। ধানের খেতে জমে থাকা জলের বুকে বিদ্যুতের মতন দৌড়াদৌড়ি করছে তেচোখো মাছের ঝাঁক। গাংশালিখ আর শামুকখোল পাখিরা কেঁচো আর শামুক খেয়ে ফুরোতে না পেরে ভোম্বলের মতন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এত মজা চারিদিকে, তুমি কিছুই দেখবে না?
ফুলকি ফিসফিস করে বলে, বোঝো না কেন ময়ূর? আমি কি আর ছোট আছি? বড় মেয়ে হয়ে গেছি না? মা আমাকে আর যখন-তখন বেরোতে দেয় না। তুমি এভাবে এসো না ময়ূর। এভাবে আমাকে লোভ দেখিও না।
মাঝরাতে ফুলকির মা ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসে। ফুলকি বলে, কী হল মা?
ময়ূরটা এত রাতে কেমন কান্নার মতন আওয়াজ করে ডাকছে শোন। বুক হিম হয়ে যায়। কি অলক্ষুণে পাখিরে বাবা! মরেও না।
ফুলকি মায়ের মুখে হাত চাপা দেয়। তারপর সে-ও কান পেতে শোনে ময়ূরের কান্না। শুনতে শুনতে তার গাল বেয়ে দুটো জলের ধারা গড়িয়ে নামে। মা অন্ধকারে সেই কান্না দেখতে পায় না।
পরদিন ফুলকি লুকিয়ে লুকিয়ে দত্তদের বাগানের বেড়ার সুপুরিগাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ময়ূরটা পেখম নামিয়ে ডানার মধ্যে মুখ গুঁজে বসেছিল। হঠাৎ ফুলকির গায়ের গন্ধে চনমন করে পাখা ঝাপটে মাটিতে নেমে আসে। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে ঠিক খুঁজে বার করে ফুলকিকে। বেড়ার মধ্যে দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেয়। ফুলকি ঝুঁকে পড়ে ময়ূরের গলায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, ভালোবাসো আমাকে? সেই প্রশ্নের উত্তরে ময়ূরের পেখম সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। তার চোখের মণিদুটো চুনির টুকরোর মতন লাল হয়ে ওঠে। ময়ূর তার বুনোকুল-খাওয়া পারঙ্গম দুই ঠোঁট দিয়ে আলতো করে কামড়ে ধরে ফুলকির স্তনবৃন্ত। ফুলকি চারিদিকে চেয়ে আস্তে আস্তে বাগানে ঢোকে। তারপর ময়ূরের সঙ্গে হারিয়ে যায় কুন্দফুলের ঝোপের আড়ালে।
প্রদীপ দত্ত মারা যাওয়ার কিছুদিন পরে ফুলকিরও সিফিলিস ধরা পড়ে।
Comments
Post a Comment