হাতকাটা মেয়ের হারমোনিয়াম
সৈকত মুখোপাধ্যায়
গলসী স্টেশনের লাল-সিমেন্টের বেঞ্চির ওপরে দু-হাতের মধ্যে হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন অমলেন্দুদা—কবি অমলেন্দু মুন্সী। পাশে আমি। অমলেন্দুদা বিড়ি খাচ্ছিলেন, আমি খাচ্ছিলাম পাঁচ টাকা প্যাকেটের চিনেবাদাম। ওনাকে বাদামের ভাগ দিতে গিয়েছিলাম...নিলেন না। বললেন, তুমি খাও। কখন বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছ। আমি তো কিছুই খাওয়াতে পারলাম না।
সত্যিই খিদে পেয়ে গিয়েছিল। সকাল এগারোটায় হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে পৌঁছেছিলাম বর্ধমান। সেখান থেকে আবার আসানসোল লোকালে গলসী। এখন বাজে বিকেল সাড়ে চারটে। মাঝখানের পুরো সময়টায় পেটে কিছুই পড়েনি। খিদে পাবে না?
এসেছিলাম ওই অমলেন্দুবাবুর খোঁজেই। কেন এসেছিলাম বলি।
আমরা তিন বন্ধু মিলে একটা কবিতা-পত্রিকা বার করি, নাম 'কিন্নর'। লিটল ম্যাগাজিন। খুব খেটেখুটে সংখ্যাগুলো বার করি বলে কবিতা-প্রেমীদের মধ্যে কিন্নরের চাহিদা আছে। ঠিক করেছিলাম সামনের বইমেলায় সত্তরের দশকের কবিদের নিয়ে একটা সংখ্যা বার করব। সত্তরের সাতজন বিশিষ্ট কবির প্রত্যেকের দশটা করে কবিতা থাকবে, অ্যানালিসিস সমেত। সঙ্গে থাকবে অল্পকথায় জীবনী আর ইনটারভিউ।
এ-ও ঠিক করে নিয়েছিলাম যে, খুব নামকরা কবিদের পেছনে দৌড়বো না। কারণ, ইতিমধ্যেই তাদের নিয়ে অনেক পত্র-পত্রিকার বিশেষ-সংখ্যা বেরিয়ে গিয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, তাদের ইনটারভিউ ইত্যাদি পাওয়ার ঝামেলাও বেশি। তাই সাতজন শক্তিমান অথচ আন্ডার-রেটেড কবির নাম বেছে নিয়েছিলাম।
তাদের মধ্যেই একজন অমলেন্দু মুন্সী, যিনি গত চল্লিশ বছরে কিছুই লেখেননি। অথচ একাত্তর-বাহাত্তর সালে এই মানুষটারই লেখা 'অন্ধের আয়না' কিম্বা 'দহনমন্ত্র'র মতন অনেক কবিতা তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ফিরত।
আমরা ভেবেছিলাম, এই হারিয়ে যাওয়া কবিকে খুঁজে বার করতে পারলে চারিদিকে হইহই পড়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হল, অমলেন্দু মুন্সীর ঠিকানা ফোন নম্বর কিছুই জানতাম না। শুধু এইটুকুই জানতাম যে, ওনার বাড়ি ছিল বর্ধমান জেলার গলসীতে। সেই সূত্র ধরেই আজ অমলেন্দু মুন্সীর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলাম। গলসী স্টেশনে নেমে লোকজনকে জিগ্যেস করতে শুরু করেছিলাম—অমলেন্দুবাবু বলে কাউকে চেনেন? কবি অমলেন্দু মুন্সী? কোথায় বাড়ি বলতে পারবেন?
পঁচিশ-তিরিশজন গলসীবাসী সেই প্রশ্ন শুনে ঘাড় নেড়ে চলে যাওয়ার পর হঠাৎ-ই একজন মাঝবয়েসি মহিলা বললেন, বাজারে গিয়ে যমুনা প্রিন্টার্সে খোঁজ করুন। অমলদা ওখানেই কাজ করেন। যমুনা প্রিন্টার্সে গিয়ে সত্যিই অমলেন্দুবাবুকে পেয়ে গেলাম।
আমাদের হিসেব মতন ওনার এখন বয়স হবে সত্তর, কিন্তু সামনাসামনি দেখে মনে হল আশি পেরিয়ে গেছে। হাড়-জিরজিরে শরীর। একটা চেককাটা নোংরা লুঙ্গি পরেছিলেন, তার ওপরে খদ্দরের কোঁচকানো মোচকানো পাঞ্জাবি আর নস্যিরঙের চাদর। মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল, পুরোটাই ধবধবে সাদা। গালের খোঁচা খোঁচা দাড়িরও সেই একই অবস্থা। একটা চৌকির ওপরে উবু হয়ে বসে প্রূফ দেখছিলেন। পরে জেনেছিলাম, ওটাই ওনার চাকরি।
আমি নমস্কার করে আমার আসার উদ্দেশ্য জানাতে ভেতরের ঘরে গিয়ে বোধহয় মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এলেন। তারপর আমাকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে বললেন, চলো ভাই, প্লাটফর্মে গিয়ে বসি। নিরিবিলি সুন্দর জায়গা।
মিনিট পাঁচেক হেঁটে আবার সেই প্লাটফর্মে ফিরে এলাম, যেখানে একটু আগে এসে নেমেছিলাম।
এসব লাইনে একঘণ্টা-দেড়ঘণ্টা অন্তর ট্রেন আসে। মাঝের এই সময়টায় শূন্য-প্লাটফর্মে শিশুগাছের ছায়ায় শালিখ পাখিরা খেলা করছিল। দূরে একটা রাইস-মিলের চিমনির ধোঁয়া উত্তুরে হাওয়ায় বারবার কী যেন একটা ছবি এঁকেই আবার মুছে ফেলছিল। অনেকদূর থেকে ভেসে আসা একটা বসন্তবৌরি-পাখির টুং টুং ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দও ছিল না এই শেষ বিকেলের রেলস্টেশনে।
অমলেন্দুদা একটা ছেঁড়া কাগজের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে সিমেন্টের বেঞ্চিটা ঘসে ঘসে মুছলেন। তারপর কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, বিশ্বাস করছ না তো? সত্যি করেই মৃত্যু ঘটেছে আমার। নাহলে কুকুরগুলো আমাকে দেখলেই অমন তারস্বরে চিৎকার করে কেন? তোমার নামটা কী যেন বললে ভাই?
এই নিয়ে তৃতীয়বার বললাম, কুশল মিত্র।
হ্যাঁ, কুশল। সমস্যাটা আমার একার নয়, আমাদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যে বেশ কয়েকজনেরই মৃত্যু হয়েছিল ওই সময়। ওই ধরো উনিশশো একাত্তর-বাহাত্তরে।
উত্তরে কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ওনার প্রথম এক-দুটো কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম, আজকের পুরো চেষ্টাটাই বৃথা গেল। এর চেয়ে যদি শুনতাম অমলেন্দু মুন্সী মারা গেছেন, তাহলেও বোধহয় এতটা হতাশ লাগত না। কিন্তু ইনি তো বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন, অথচ কবিতা নিয়ে উনি কিছুই বলবেন না, বলতে পারবেন না। কারণ, ওনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
একটু আগে, আমরা যখন ছাপাখানার ভেতর থেকে সবে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছি, তখন হঠাৎ একটা গলাখাকারির আওয়াজে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছিলাম যমুনা প্রিন্টার্সের মালিক দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে ঘুরে তাকাতে দেখে উনি নিজের মাথার ওপরে ডান হাতের তালুটা তিন-চার পাক ঘুরিয়ে বাঁ-হাতে অমলেন্দুবাবুকে দেখালেন। তারপর চোখ কুঁচকে হাসলেন।
ওনার ইশারা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। তবু ভেবেছিলাম, সব কবিই তো অল্পবিস্তর দিব্যোন্মাদ। হয়তো ইনিও তাই। হয়তো সেই উন্মাদনার মধ্যেই এমন কোনো কথা বলে বসবেন যা পড়ে কিন্নরের পাঠকেরা ধন্য ধন্য করে উঠবে।
কিন্তু হায়, এ তো দেখছি মৃত্যুর স্বপ্নে ডুবে থাকা একটা লোক। তখন থেকে একটাই কথা বলে যাচ্ছেন — উনি মৃত। ওনার অগুরুর গন্ধ ভালো লাগে। ওনার সঙ্গে মৃত মানুষদের কথাবার্তা হয়। ঘুম না এলে উনি কপালে চন্দন আর চোখের ওপরে তুলসীপাতা চাপিয়ে শুয়ে থাকেন। তাতে নাকি চমৎকার ঘুম এসে যায়।
শেষ চেষ্টা হিসেবে একবার ওনাকে বললাম, দেখুন অমলেন্দুদা, আপনি যদি মরেই গিয়ে থাকেন, তাহলে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন কীভাবে? প্রূফ দেখছেন কীভাবে? বিড়ি খাচ্ছেন কীভাবে? আপনাকে তো তাহলে বহু আগেই শ্মশানে নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে দিত, তাই না?
উনি ঘাড় নেড়ে বললেন, উঁহু। ভ্যাম্পায়ারের কামড় খেয়ে যারা মরে, তাদের সৎকার হয় না। তারা নিজেরাও ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায়।
আমি এত দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেললাম। বললাম, আপনি ভ্যাম্পায়ার?
আমি একা নই। এই গলসী শহরে আমার বয়সি আরো চারজন মানুষ ভ্যাম্পায়ারের জীবন কাটাচ্ছে। তবে দিনকালের সঙ্গে আমাদের মানিয়ে চলতে হয়। এখন নিয়ম-রক্ষার মতন দিনে এক দু-ফোঁটা নররক্ত খাই।
কোত্থেকে পান?
সেটা আমাদের সমিতির গুপ্ত কথা। তোমাকে বলতে পারব না।
কী আর বলব? বুঝতে পারছিলাম, সব কথাই চুপচাপ হজম করে যেতে হবে। কবি অমলেন্দু মুন্সীকে যে খুঁজে পেয়েছিলাম সে-কথা কোথাও লেখা যাবে না, কারণ এসব কথা লেখা মানেই ওনার শান্তি নষ্ট করা। একজন আধপাগলা মানুষ পৃথিবীর এক কোনায় নিজের উদ্ভট ধারণা নিয়ে পড়ে আছেন, থাকুন না। কারুর কোনো ক্ষতি তো করছেন না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে রইলাম। ডাউন-ট্রেন আসতে এখনো একঘণ্টা দেরি আছে। ততক্ষণ বসে থাকা ছাড়া উপায় কী? পাশে বসে অমলেন্দু মুন্সী একটু ভারী গলায় গুণগুণ করে তাঁর ছোটোবেলার কি যেন গল্প বলে চলেছিলেন। প্রথমটায় পাত্তা দিইনি। কিন্তু মন দিয়ে এক দুটো লাইন শুনতেই বঁড়শিতে মাছের মতন গেঁথে গেলাম।
এই মানুষটার পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি, না-খেতে-পাওয়া চেহারা। এনার বাঁ দিকের চশমার কাচ-টা ফাটা, ইনি আমার চোখের সামনেই আধখানা বিড়ি খেয়ে বাকিটা দেশলাই-বাক্সের মধ্যে জমিয়ে রাখলেন। তবু বেশ বুঝতে পারছিলাম, একসময় এই মানুষটাই শব্দের প্রভু ছিলেন। সেই শব্দসিদ্ধি এখনো ওনাকে ছেড়ে যায়নি।
এমন সুন্দর করে উনি কথা বলে যাচ্ছিলেন, এমন অল্প কথায় তুলে আনছিলেন হারানো একটা সময়কে যে, সেই গল্প একটু একটু করে চোরাবালির মতন আমাকে নিজের ভেতরে টেনে নিচ্ছিল। আমার চোখ থেকে মুছে গেল দু-হাজার-ষোলোর গলসী স্টেশন, কান থেকে মুছে গেল বসন্তবৌরির ডাক। আমি সম্মোহিতের মতন শুনতে শুরু করলাম সেই কাহিনি।
দুই
কুশল, কুশল বললে তো তোমার নাম? শোনো কুশল। এখন তুমি গলসী জায়গাটাকে যেরকম দেখছ, পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে সেরকম ছিল না। আমাদের জ্ঞান হওয়ার পর দেখেছিলাম এক অদ্ভুত মায়াময় শহর।
'মায়া' শব্দটার দুরকম মানে হয়, জানো নিশ্চয়? মারীচ রাক্ষস ছিল মায়াবী, কারণ, সে জাদু জানত। জাদু জানত আমাদের ছোটবেলার গলসী শহরটাও। চেনা রাস্তাও তখন হঠাৎ হঠাৎ অচেনা হয়ে যেত। বর্ষাকালে রাস্তার দুপাশের নয়ানজুলি ভরে উঠত ছোট ছোট নীলরঙের কলমি ফুলে। গ্রীষ্মে সেই একই নয়ানজুলির শুকনো বুক আবার লাল হয়ে যেত ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়ায়।
একদিন ক্যানালের পাড়ে বসে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছি। একটা বস্তা ভাসতে ভাসতে আমাদের সামনে আঘাটায় এসে ঠেকল। এখনো মনে আছে, বৃষ্টিথামা বিকেল ছিল সেটা। আকাশে অদ্ভুত হলুদ একটা আলো ফুটেছিল। সেই কনে দেখা আলোয় দেখেছিলাম, বস্তাটার মধ্যে থেকে অপূর্ব লাবণ্যময় দুটো পা বেরিয়ে রয়েছে। গুরুভার উরু থেকে আলতা পরা পায়ের পাতা অবধি—নিটোল, ফর্সা, নির্লোম দুটো মেয়েমানুষের পা—সোনার মতন ঝকমক করছিল।
সেই যে দশ বছর বয়সে ওই দৃশ্যটা দেখে ফেললাম, তারপর থেকে কোনোদিনও আর নারীর নগ্নতা থেকে মৃত্যুকে আলাদা করতে পারিনি। যখনই সঙ্গম করেছি, তা যেন শবের সঙ্গে।
আমাদের ছোটবেলায় এই মফস্বল শহরের মেয়েরা ফ্রক পরে স্কুলে যেত। তারা দুহাত দিয়ে বুকের কাছে ধরে থাকত বঙ্গলিপি খাতা আর হোম-সায়েন্সের বই। ওই ছিল তাদের লজ্জার আড়াল। ওইভাবেই সেই বারো-তেরোর মেয়েগুলো তাদের বুকে সদ্য গজিয়ে ওঠা কুঁড়িগুলোকে আড়াল করে পথ চলত। আমার মতন অ্যাডোলেসেন্ট ছেলেরা আড়চোখে চেয়ে দেখতাম। ভালো করে বুঝতাম না সবকিছু।
আমার যখন পনেরোবছর বয়স তখন গলসী পোস্টঅফিসে পোস্টমাস্টার হয়ে এলেন প্রবোধ সরকার। প্রবোধবাবু আমাদের পাড়াতেই একটা একতলা বাড়ি ভাড়া নিলেন।
প্রবোধবাবু, ওনার স্ত্রী আর ওদের মেয়ে কেয়া—এই তিনজনের সংসার। কেয়া আমাদের পাড়াতেই বড় হতে লাগল। একা-একা রাস্তায় বেরোতে শুরু করল। আর ওর বুকের দিকে তাকিয়েই আমরা মেয়েদের স্তনের উগম থেকে উন্নতি অবধি পুরো পর্যায়টা জলের মতন বুঝে গেলাম। রাস্তায় বেরোলে বেচারা কেয়া অন্য মেয়েদের মতন বুক আড়াল করতে পারত না। কিছুই আড়াল করতে পারত না। কারণ, কেয়া জন্মেছিল দুটো হাত বাদ দিয়ে। নাক, চোখ, পা, পিঠ, বুক, পাছা—সব ঠিক ছিল। শুধু হাতদুটোই ছিল না। কাঁধের পর থেকে একদম ল্যাপাপোছা, প্লেন। কাকিমা ফ্রকের হাতাগুলো মুড়ে সেলাই করে দিতেন। সেই সব ফ্রক পরে কেয়া রাস্তার দিকে চোখ নামিয়ে হাঁটত।
তোমাকে বললাম কি, কেয়ার মুখটা ছিল খুব সুন্দর? পানপাতা গড়নের মুখ, ছোট্ট কপাল, টিকোলো নাক। আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো, কুশল? কেয়ার চোখ কেমন ছিল জানতাম না। কেন বলো তো? আসলে ও তো কোনোদিন কারুর দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। যারা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তাদের শিউরে ওঠা মুখের ভাব ও দেখতে চাইত না।
ন'বছরের কেয়া উনিশ বছরের হল। পনেরো বছরের আমি পঁচিশে পৌঁছলাম। আমার সমস্ত কবিতার মধ্যে গোপনে কেয়ার কথা থাকত, যদিও আমি কেয়ার প্রেমে পড়িনি। কেয়ার মতন হাতকাটা মেয়ের প্রেমে পড়া কী কারুর পক্ষে সম্ভব? জানি না। আমার শুধু ভীষণ মায়া লাগত ওর জন্যে। সেই মায়াটাই কবিতা হয়ে ফুটে বেরোত।
অদ্ভুত ব্যাপার, কেয়ার জন্যে ওর মা-বাবার মনে কোনো মায়া ছিল না। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।
তোমার বয়স কত কুশল? ছত্রিশ? তাহলে তুমি ঘরে-ঘরে টিভি ঢুকে যাওয়ার অনেক পরে জন্মেছ। তোমার কাছে 'এনটারটেইনমেন্ট' শব্দটার মানেই আলাদা। আমাদের এনটারটেইনমেন্ট ছিল দোলের মেলায় পুতুল-নাচ, মাঠে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা, পুজোর পরে খোলা মাঠে পাড়ার গায়ক-গায়িকাদের নিয়ে জলসা আর নাটক।
আরো কিছু কিছু ইউনিক জিনিস ছিল। যেমন, অবিরাম-সাইকেল আর হাতকাটা মেয়ের হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করা।
হ্যাঁ, প্রবোধবাবু পোস্টমাস্টার হঠাৎই একদিন তার মেয়েকে দিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিলেন। খুব হঠাৎ নয়। প্ল্যান একটা নিশ্চয়ই ছিল। নাহলে মেয়েকে অত যত্ন করে গানই বা শেখাবেন কেন?
বিভিন্ন বড় মাপের জলসায় কেয়া ওর মায়ের সঙ্গে স্টেজে উঠতে শুরু করল। এর জন্যে তখনকার দিনে প্রবোধবাবু তিনশোটাকা করে চার্জ করতেন। তবে কেয়া যখন একপা দিয়ে হারমোনিয়ামের বেলো টেনে অন্য পায়ের আঙুল দিয়ে রিড টিপে মধুর সব সুর তুলত আর তার সঙ্গে মিঠে গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে শুরু করে একের পর এক বোম্বে-ফিল্মের গান গেয়ে যেত, তখন উদ্যোক্তাদের পয়সা উশুল হয়ে যেত। শুধু গানই নয়, শো-এর মধ্যে বৈচিত্র্য আনবার জন্যে প্রবোধবাবু এবং তার স্ত্রী কেয়াকে দিয়ে অঙ্কটঙ্কও করাতেন। সবই সে করত পায়ের আঙুলে খাতা-কলম ধরে।
আমি মাঝে মাঝে কেয়ার এরকম দু-একটা পারফর্মেন্স দেখেছি, কিন্তু আমার ভালো লাগত না। আমি দেখতাম, কেয়া একঘণ্টার প্রোগ্রামের মধ্যে একবারের জন্যও চোখ তুলত না। কষ্ট হত, খুব কষ্ট হত আমার।
এই সময়েই একটা ঘটনা ঘটল। প্রবোধবাবুর স্ত্রী, মানে কেয়ার মা, এনকেফেলাইটিসে মারা গেলেন। অন্য পরিবারে হলে এটাকে হয়তো বিনামেঘে বজ্রপাত বলা যেত। কিন্তু পোস্টমাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে বিশেষ কিছু বদল এল না। কেয়া তার অদ্ভুত সক্ষম দুটো পায়ের সাহায্যে ঘরসংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করে যেত। গানের রেওয়াজ করত। পুজোর পর থেকে গোটা শীতকালটা জুড়ে চুটিয়ে ফাংশান করত। শুধু ওর মাথায় বিনুনিটা আর দেখতাম না। চুল এলো হয়ে থাকত। নিজের পা দিয়ে নিশ্চয় নিজের বিনুনি বাঁধা যায় না।
তিন
খুব দ্রুত সন্ধে নেমে আসছিল। ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে পাঁচটা বাজে। আমার কলকাতায় ফেরার ট্রেন আসতে এখনো আধঘন্টা দেরি আছে।
স্টেশনের চারিদিকে মাইল মাইল ধানখেত। ধান কাটা হয়ে গেছে। সেই ফাঁকা খেতের ওপরে এখানে-ওখানে সাঁজালের নীল ধোঁয়া জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। রেললাইনের বেড়ার ধারে আকন্দের ঝোপে মুঠো মুঠো জোনাকি জ্বলছিল।
আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এত গুছিয়ে যিনি কথা বলতে পারেন, তার মাথায় কেমন করে ভ্যাম্পায়ারের ভূত ঢুকে গেল? না কি পুরোটাই অমলেন্দুদার চালাকি? কোনো একটা ফ্রাস্ট্রেশন থেকে নিজের কবিসত্ত্বাটাকে কিছুতেই পরের প্রজন্মের সামনে বার করবেন না। সেইজন্যেই পাগল সেজে বসে আছেন?
অমলেন্দু মুন্সী একটা বিড়ি ধরিয়েছিলেন। একটু পরে সেটাকে টুসকি মেরে রেললাইনের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, বলছিলাম না, শহরটার অনেক মায়া ছিল? সেটা সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারতাম মুসাফিরের গলিতে ঢুকলে।
আমি বললাম, কেয়ার কথা কী বলছিলেন যে?
উনি বললেন, গলিটার কথাও বলতে হবে। আমার বিশ্বাস মুসাফিরের গলির মতন একটা জায়গা না থাকলে ভ্যাম্পায়ারের জন্ম হত না।
বলুন তাহলে।
গলিটা ছিল আমাদের বাড়ির গায়েই। একদিকে মুন্সীবাড়ির টানা লম্বা দেয়াল, অন্যদিকে একটা ভবঘুরে আশ্রমের পাঁচিল। মাঝখানে ওই সরু গলিটা পায়ে হেঁটে পেরোতে সময় লাগত এই ধরো মিনিট সাতেক।
নাম থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুই অদ্ভুত ছিল ওই গলিটার। কে মুসাফির, সে কবেকার লোক কিছুই জানতাম না। ভাবো তো, যে লোক মুসাফির, মানে সোজা বাংলায় পথিক, তার কেন শুধু একটা সরু গলি থাকবে? তার তো থাকা উচিত পুরো পৃথিবী।
গলিটার একদিকে জমজমাট বাজার, অন্যমুখে একটা বিশাল পোড়ো জমি। এই অদ্ভুত কম্বিনেশনের জন্যেই মুসাফিরের গলি ধরে কেউ যাতায়াত করত না।
যাতায়াত না করলেও গলিটায় ঢুকে পড়ত কিন্তু অনেকেই। তার মানে, জায়গাটার একটা অদ্ভুত টান ছিল। আমিই তো খিড়কি-দরজা খুলে বেরিয়ে কত ঘুঘুডাকা দুপুরে, কত তারাখসা সন্ধেয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছি ওই গলির এককোণে।
শহরের মাঝখানে একটা গলি, তার দেয়ালে জাত-সাপের খোলশ ঝুলছে, পাঁচিলের ফোকর থেকে মুখ বাড়াচ্ছে ভুতুম প্যাঁচা, ভাম। ভাবা যায়? যখন কোথাও কোনো হাওয়া নেই তখন ওই গলির মধ্যে ঝড়ের মতন হাওয়া বইত। যখন কোথাও কুয়াশা নেই, তখন রাশি রাশি কুয়াশায় ঢেকে যেত গলির একফালি আকাশ। তার মধ্যেই ভেসে আসত আশ্রমবাসী ভবঘুরেদের বিষণ্ণ কীর্তন। মনে হত, এক জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে যেন অনেক দূর দিয়ে ভেসে যাওয়া অন্য এক জাহাজের নাবিকদের গান শুনছি।
একাত্তর সালের সেই বসন্তকালটা জীবনে ভুলব না। এমন তীব্র বসন্ত তার আগে কিম্বা তার পরে কখনো দেখিনি। এত পলাশ, এত কোকিল, এত নেশা-ধরানো হাওয়া—নাঃ, দেখিনি। আমরা গলসী শহরের যুবক-যুবতীরা মাতাল হয়ে গেলাম। দীওয়ানা হয়ে গেলাম। হাতে হাতে গোপন ইস্তাহারের মতন ঘুরতে লাগল প্রেমের চিঠি। এই রেললাইনেই একমাসের মধ্যে গলা দিল দুটো মেয়ে আর একটা ছেলে। আর বললে বিশ্বাস করবে না, কেয়া প্রেগন্যান্ট হল।
ওই নুলো মেয়েটাও কি ভালোবাসা পেয়েছিল? না কি শুধু শরীরটাই কেউ ভোগ করে গেল? সে কে? কিছুই জানতে পারলাম না।
চৈত্রমাসের এক সন্ধ্যায় প্রবোধবাবু চোরের মতন আমার ঘরের জানলায় টোকা মেরে ডাক দিলেন, তোমাদের মধ্যে কারুর বি পজিটিভ ব্লাড আছে? বি পজিটিভ? আমার মেয়েটার ব্লাড লাগবে, অনেক ব্লাড। ওর শরীর থেকে সব রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। অমু, তুমি তো আমার ছেলের মতন, কেয়া তোমার বোন। শিগগির চলো বাবা, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে চলো। আমার মেয়েটাকে বাঁচাও।
ওই বয়সে আমরা প্রায়ই ব্লাড-ডোনেশন ক্যাম্পে রক্ত দিতাম। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কার কোন গ্রুপের রক্ত মুখস্থই ছিল। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে চটপট সেরকম চার বন্ধুকে ডেকে নিলাম যাদের বি পজিটিভ গ্রুপের ব্লাড—শঙ্কু, রতন, পাপ্পু ,অভী।
কপালজোরে আমার নিজেরও ছিল বি-পজিটিভ গ্রুপের রক্ত। আমরা পাঁচ বন্ধু প্রবোধবাবুর পেছন পেছন দৌড়তে দৌড়তে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। সেখান থেকে বাস ধরে বর্ধমান শহরের বাইরের দিকে একটা ভাঙাচোরা বাড়িতে যখন ঢুকলাম তখন রাত দুপুর। ভেতরে ঢুকে বুঝলাম, ওটা অ্যাবরশন করার গোপন আস্তানা। বিপত্নীক প্রবোধবাবু কাঁদতে কাঁদতে বললেন, পুরুষমানুষ হওয়ার কারণে তিনি অনেকদিন অবধি কিছুই বুঝতে পারেননি। যখন বুঝলেন তখনই এখানে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এরা যে কী করেছে, অসম্ভব রক্ত বেরোচ্ছে কেয়ার শরীর থেকে।
আমিই প্রথম ঢুকেছিলাম রক্ত দেওয়ার জন্যে। সাদা চাদরে ঢাকা কেয়ার শরীরটা অসম্ভব সরু লাগছিল। কিন্তু সেই শরীর তখন আর রক্ত নেওয়ার মতন অবস্থায় ছিল না। ও ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছিল। আমাকে অ্যাবরশন- স্পেশালিস্ট হাতুড়ে ডাক্তার বলল, বাইরে গিয়ে বসো। আর রক্ত দিয়ে লাভ নেই।
আমি বললাম, শুয়োরের বাচ্চা। মেয়েটাকে মেরে ফেললি? লোকটা মুখ ভেঙিয়ে বলল, এত দেরি করে এলে কী করব? ছ'মাসের ফিটাসকে বার করতে গেলে এসব রিস্ক থাকবেই।
বেরিয়েই আসছিলাম। হঠাৎ কেয়ার দিকে চোখ পড়ল। ও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। এই প্রথম আমি ওর চোখ দেখলাম। কিন্তু সে কী চোখ! কোনো মানুষের চোখ ওরকম হয়? পরিষ্কার দেখলাম, ওর চোখের মণিদুটো লুডোর ঘুটির মতন লাল। আমার দিকে তাকিয়ে কেয়া ফিসফিস করে বলল, অমুদা, রক্ত দাও। রক্ত দাও না! আমার যে বাঁচতে ইচ্ছে করছে অমুদা। তার পরেই ওর চোখের পাতাদুটো ভারী হয়ে নেমে এল। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের বললাম, চল। আর কিছু করার নেই।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেলাম পাপিয়ার ডাক। বাতাসে হাসনুহানার মাতাল-করা গন্ধ। এই সবকিছুকেই মনে হল খুব দক্ষ শিকারির হাতে সাজিয়ে রাখা একটা ফাঁদ, যে ফাঁদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল কেয়া নামের হাতকাটা মেয়েটা।
কেয়া কি সেই রাতেই মারা গিয়েছিল? জানি না। মারা গেলেও কোথায় কারা ওর সৎকার করল? আমরা পাড়ার ছেলেরা কিছুই জানলাম না কেন?
দুদিন পরে প্রবোধবাবুর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম, বাড়ি ফাঁকা। বাড়িওলা তারকজ্যাঠামশাই হাঁকডাক করে মেঝে সাফ করাচ্ছেন। পরের ভাড়াটে ঢুকবে, তার প্রস্তুতি আর কি। খুবই অবাক হয়ে গেলাম। এত তাড়াতাড়ি প্রবোধবাবু সব গুটিয়ে ফেললেন কীভাবে?
চার
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, অমলেন্দুদা, এসব তো ভয়ঙ্কর ডিপ্রেসিং ব্যাপার। কেন এইসব পুরোনো স্মৃতি ঘাঁটাঘাঁটি করেন?
উনি বললেন, কী বলছ তুমি? ওই কেয়া, ওই মুসাফিরের গলি আর ভাঙা লেটার-বক্স—এই তিনটে ফ্যাক্টর মিলেই তো আমার জীবনটা বরবাদ করে দিল। ভাবব না এদের কথা!
আমি অবাক হয়ে বললাম, লেটার-বক্স আবার এলো কোথা থেকে?
কোথাও থেকে আসেনি। ওখানেই ছিল। ওই মুসাফিরের গলির মধ্যে।
গলিটার মাঝামাঝি একটা বাঁকের মুখে ওই পুরোনো ভাঙাচোরা লেটার-বক্সটাকে জন্ম থেকেই দেখে আসছিলাম। দেয়ালে ঝোলানো ছোট সাইজের লেটার-বক্স নয়, মাটিতে দাঁড় করানো বড় লেটার-বক্স, যেটার মাথাটা প্রায় আমার কাঁধের কাছাকাছি পৌঁছোয়। কোন বুদ্ধিতে কবে ওটাকে ওখানে বসানো হয়েছিল কে জানে! ওই গলিতে কে চিঠি ফেলতে আসবে? বাক্সটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল।
কেয়া মারা যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন মুসাফিরের গলিতে যাওয়া হয়নি। দিন পনেরো বাদে হঠাৎ-ই কী মনে হতে ওখানে গেলাম। গিয়ে দেখি ভারি অদ্ভুত এক দৃশ্য। লেটার-বক্সটার রূপ বদলে গেছে। একটা তেলাকুচোর সতেজ লতা বাক্সটার গায়ে জড়িয়ে জড়িয়ে উঠেছে, তাই ওটাকে এখন ঘিরে রেখেছে বরফের মতন সাদা ফুল আর জমাট রক্তের মতন লাল ফলের ঝালর। শুধু তাই নয়, গলির ইট-বাঁধানো রাস্তার ফাঁক-ফোকর দিয়ে কীভাবে যেন গোছা গোছা ঘাস গজিয়ে উঠে লেটার-বক্সটার কোমর অবধি ঢেকে ফেলেছে। ফলে ওটাকে আর লেটার-বক্স মনে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল হাওয়াই দ্বীপের এক হুলা-নর্তকী। পল গঁগ্যার পেইন্টিং-এর নায়িকা। তার গলায় আর এলোচুলে ফুলের মালা জড়ানো, কোমরে ঘাসের ঘাঘরা।
ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, তুমি বিশ্বাস করবে না কুশল, আমার প্রবল ইরেকশন হল। মনে হল ওই তেলাকুচো লতার আড়াল সরালেই দেখতে পাব শ্যামল দুই স্তন। ঘাসের আড়াল সরিয়ে হাত বাড়ালেই হাতের মুঠোয় পেয়ে যাব নরম এক যোনি। কামজ্বরে পুড়তে পুড়তে আমি বাড়ি ফিরে এলাম।
তাতেও কি শান্তি ছিল? সেই লেটার-বক্সটার তন্বী শরীর সারাক্ষণ মাথার ভেতরে ফিসফিস করে বলছিল, আমার ঠান্ডা কোমরে তোমার গরম হাতের তালু রাখো অমল, উলটে দাও ফ্ল্যাপ, দুটো আঙুল ভেতরে ঢুকিয়ে দাও। চিঠি ফেল...চিঠি ফেল আমার গভীর কন্দরে। একটা ভালোবাসার চিঠির জন্যে কবে থেকে বসে রয়েছি। তোমার কি মায়া হয় না?
কবিতার খাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে লিখতে বসলাম জীবনের প্রথম প্রেমপত্র। কাকে লিখব জানি না, কোন ঠিকানায় পাঠাব জানি না। শুধু এইটুকু জানি লিখতে হবে এবং ওই রমনীয় লেটার-বক্সের মধ্যে ফেলে আসতে হবে।
ঘোরের মধ্যে কী লিখেছিলাম জানি না। খাম ছিল না, ডাকটিকিট ছিল না। খাতার কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে নিয়ে রাত ন'টার সময় আমাদের বাড়ির ছাদে উঠে গেলাম। ছাদের একটা বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে গলির মধ্যে লেটার-বক্সটাকে দেখা যায়। আমি নিশ্চিত হতে গিয়েছিলাম, জায়গাটা ফাঁকা আছে কিনা।
না, ফাঁকা ছিল না। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটাকে চিনতে পারলাম। আমারই বন্ধু, শঙ্কু। আমার সঙ্গে কেয়াকে ব্লাড দিতে গেছিল। আমি ছাদ থেকে ঘরে ফিরে এলাম।
সেই রাত্রেই একঘণ্টা দেড়ঘণ্টা অন্তর আরও তিনবার ছাদে গেলাম। প্রত্যেকবারই দেখলাম লেটার-বক্সের সামনে কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ তখন গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার সময় নয়। তখন অনেক রাত। পাগলা কুকুর, বিষাক্ত পোকা, খুনি, উন্মাদ, বেশ্যা—এদের রাস্তায় নেমে আসার সময় তখন। তবুও ওরা ওই অত রাতে চিঠি ফেলতে গিয়েছিল।
ওদের প্রত্যেককে চিনতে পেরেছিলাম। আমার অনেকদিনের বন্ধু যে ওরা। রতন, পাপ্পু, অভী। মনে আছে তো কুশল, এই তিনটে নাম? শঙ্কুর মতন ওরাও সেদিন কেয়াকে ব্লাড দিতে গিয়েছিল।
ওরা প্রত্যেকেই চিঠি ফেলেছিল, তারপর এক এক করে ফিরে গিয়েছিল। কারুর সঙ্গে কারুর দেখা হয়নি।
ওরা চারজন ফিরে যাওয়ার পর আমি গেলাম। তখন ভোর হয়ে এসেছে। ভোরের হিমে তেলাকুচোর লতা পাতা ফুল সব কিছুই কেমন যেন ভিজে গিয়েছিল। ভিজে ফুল থেকে যে এমন মাংসল গন্ধ ছাড়ে তা আমি আগে জানতাম না। আমি লতার আড়াল সরিয়ে, ফ্ল্যাপ-টাকে বাঁ-হাত দিয়ে ওপরে তুলে, আমার চিঠি-সমেত ডানহাতটা লেটার-বক্সের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে তাল তাল ঊষ্ণ, কোমল, পিচ্ছিল মাংস আমার হাতটাকে চারিদিক থেকে জড়িয়ে ধরল। আমার সমস্ত স্নায়ু বেয়ে আগুনের হলকা দৌড়চ্ছিল। প্রতিটি পেশী মাছবাজারের খোবলানো কচ্ছপের হৃৎপিণ্ডের মতন থরথর করে কাঁপছিল। কতক্ষণ ওইভাবে কেটেছিল জানি না, হঠাৎ একটা অর্গ্যাজমিক বিস্ফোরণে আমার হাতের মুঠো আলগা হয়ে চিঠিটা খসে পড়ল লেটার-বক্সের মধ্যে।
তৃপ্তির অবসাদে তখন আমি ক্লান্ত। হাতটা বার করে আনতে-আনতে দেখলাম, লেটার-বক্সের অন্ধকার পেটের মধ্যে থেকে দুটো চোখের তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লুডোর ঘুঁটির মতন লাল দুটো চোখের তারা। আমি বাড়ির দিকে ফিরে যেতে যেতে খুব খানিক হাসলাম। সত্যি, আগেই বোঝা উচিত ছিল। অত সরু লেটার বক্সের মধ্যে খুব সরু একটা মেয়ে ছাড়া আর কে ঢুকতে পারে? যার কাঁধের দু-দিকে হাত নেই, সেইতো শুধু লেটার-বক্সের মধ্যে বাসা বাঁধতে পারে, তাই না?
এই অবধি বলে অমলেন্দুদা চুপ করে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আর ধৈর্য রাখতে না পেরে জিগ্যেস করলাম, তারপর?
তারপর আর কী? দিনের পর দিন কেয়া ওইভাবে আমাদের দিয়ে প্রেমপত্র লিখিয়ে নিত, তারপর সেই চিঠি ফেলতে গেলে আমাদের কব্জির শিরা থেকে রক্ত চুষে খেয়ে নিত। এইভাবে একইসঙ্গে ওর ভালোবাসার তৃষ্ণা আর রক্তের তৃষ্ণা, দুটো তৃষ্ণাই মিটে যেত। কিন্তু আমরা পাঁচজন মরে গেলাম। আমরা ভ্যাম্পায়ার হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কেউ বুঝতে পারে না অবশ্য। তুমি আমাকে একজন জ্যান্ত কবি হিসেবে দেখতে চাইছিলে, তাই তোমাকে সব কথা খুলে বলতেই হল।
প্লাটফর্মের শেষ মাথায় সিগনালের আলো কিছুক্ষণ আগেই লাল থেকে সবুজ হয়ে গিয়েছিল। এবার এগিয়ে আসা ট্রেনের ভোঁ শুনতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তখনই দেখতে পেলাম চারজন বৃদ্ধকে। কখন যে ওনারা আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বুঝতে পারিনি। চারজনকেই অমলেন্দুদার মতন দেখতে। ওইরকমই রোগা, মাথাভর্তি পাকা চুল। পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি আর চাদর। অমলেন্দুদার পাশে বেঞ্চিতে এসে ওরা বসলেন। অমলেন্দুদা একটু হেসে আমাকে বললেন, এদের কথাই বলছিলাম। এরাই হচ্ছে শঙ্কু, পাপ্পু, রতন আর অভী। আমার অনেকদিনের বন্ধু।
আমি ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে শেষবারের মতন একবার গলসী স্টেশনের প্লাটফর্মের দিকে তাকালাম। আবছা অন্ধকারের মধ্যে থেকে পাঁচটা হাত খাড়া হয়ে উঠে আমাকে বিদায় জানাল। পাঁচটা ডানহাত—রোগা, সাদা, রক্তহীন।
Comments
Post a Comment