সূর্যাস্তের ছবি - ঈশ্বরের নষ্ট ভ্রূণ - সৈকত মুখোপাধ্যায়

সূর্যাস্তের ছবি

সৈকত মুখোপাধ্যায়


এক

 

 ফাঁকা দোকান। কাউন্টারের ওপাশ থেকে বোবা-দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন দোকানদার রতনচন্দ্র জাটি। 

তারের বাঁধন ছিড়ে 'গ্যালাক্সি স্টুডিয়ো' লেখা টিনের সাইনবোর্ড একদিকে কেতরে পড়েছে। শো-কেসের কাচে জমাট ময়লা। দেয়ালে ঝুলন্ত ঠাকুরের আসনের ওপর বসে শুঁড় নাড়াচ্ছে প্রমাণ সাইজের একটা আরশোলা। 

কতক্ষণ বাদে কে জানে, চায়ের দোকানের ছেলেটা চলটা-ওঠা কাউন্টারের ওপরে ঠক করে একটা মাটির ভাঁড় বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। রতনবাবুর ঘষা কাচের মতন চোখে একটু ছায়া পড়ল। তার হাতটা আস্তে আস্তে এগিয়ে এল, যেন বুড়ো কচ্ছপের খোলসের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা সরু গলা। তারপর চা শেষ করে,খালি ভাঁড়টা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার শুধু চেয়ে থাকা আর চেয়ে থাকা। 

দোকানটার দিকে একবার দেখলেই বোঝা যায় গ্যালাক্সি স্টুডিয়ো একটা আধমরা ব্যবসা আর তার মালিক রতন জাটি একজন হেরে যাওয়া মানুষ। 

চাঁদনি মার্কেটের পেছনদিকে পাঙ্খা-গলি চেনেন কি আপনারা? সরু গলি। আলো ঢোকে না, হাওয়া ঢোকে না। ছোট-ছোট ঘরে স্তূপাকার আর্মেচার, ইলেক্ট্রিকের তার, বল-বেয়ারিং আর রডের মধ্যে বসে হিন্দুস্থানি কারিগরেরা নানা মডেলের সিলিং-ফ্যান বানিয়ে চলেছে। অনেক নামকরা পাখা-কোম্পানি ওই পাঙ্খা-গলি থেকেই ফ্যান কিনে নিজেদের স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করে, আমরা জানতেও পারি না।

সে যাই হোক। ওই গলির ভেতরেই একটা ছোট ঘরে গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে গ্যালাক্সি স্টুডিয়ো নামে এই দোকানটা ব্যবসা চালাচ্ছে। এটাকে শুধু দোকান না বলে দোকান-কাম-ওয়ার্কশপ বলাই ঠিক। কারণ একসময় এখান থেকে ক্যামেরা, ফিল্ম, ফ্ল্যাশলাইট, ট্রাইপড এসব যেমন বিক্রি হত তেমনি ক্যামেরা সারানোর কাজও চলত। সত্যি কথা বলতে কি ক্যামেরা সার্ভিসিং-এর কাজটাই ছিল রতনবাবুর আসল ব্যবসা। 

তখনও ক্যামেরা জিনিসটা আজকের মতন ফুটপাথে ঢেলে বিক্রি হত না। একটা অরিজিনাল জাপানি আসাহি-পেন্ট্যাক্স কিম্বা ইয়াসিকা ক্যামেরার জন্যে তখনকার হিসেবে অনেক টাকা খরচা করতে হত। তাই মালিকরা চাইতেন সারানোর সময় সেই ক্যামেরাটা যেন সত্যিকারের কাজ-জানা লোকের হাতে পড়ে। এ ব্যাপারে দারুণ সুনাম ছিল রতনচন্দ্র জাটির আর সেই সুনামের জন্যেই দূরদূরান্ত থেকে দামি ক্যামেরার মালিকেরা খুঁজেপেতে পাঙ্খাগলির ওই ঘুপচি দোকানে ভিড় জমাতেন। 

রতন জাটির নিজের হাতে পত্তন করা এই দোকান। প্রথম যখন দোকান খোলেন তখন তার নিজের বয়স পঁচিশ। প্রথম পনেরো বছর খুব ভালো ব্যবসা করেছিলেন। তার পরের দশ বছরও টেনেটুনে চলেছিল। কিন্তু গত দশ বছর যাকে বলে একেবারে 'মাছি তাড়ানোর দশা'। কারণ ডিজিটাল ক্যামেরার দাপট। 

রতন জাটি বুঝতেন ম্যানুয়াল ক্যামেরার কলকব্জা। লেন্স বুঝতেন, প্রিজম বুঝতেন। ম্যানুয়াল ক্যামেরার পেটের ভেতরে যত কলকব্জা—সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম লিভার, সেন্সর, মোটোর, ব্যালেন্স—সবই নিজের হাতের চেটোর মতন চিনতেন। কিন্তু তিনি মাইক্রোচিপস আর সার্কিট-বোর্ডের কিছুই বুঝতেন না। ফলে ডিজিটাল ক্যামেরা মার্কেট দখল করে নিতেই তিনি প্রায় বেকার হয়ে পড়লেন। 

ইদানিং রতন জাটি সারাদিন উল্টোদিকের ইট বার করা বাড়িটার কার্নিশের দিকে তাকিয়ে আকাশপাতাল কী ভেবে চলেন তা আমাদের পক্ষে নিখুঁতভাবে জানা সম্ভব নয়, তবে আন্দাজ করতে পারি। আন্দাজ করতে পারি যে, তার চিন্তার অনেকটাই জুড়ে থাকে তার একমাত্র সন্তান, মা মরা মেয়ে অর্ণার ভবিষ্যৎ। 

অর্ণার বয়স বত্রিশ, অথচ তার এখনো বিয়ে হয়নি। অর্ণা কানা নয়, খোঁড়া নয়। সে এই বত্রিশেও সুন্দরী, বাইশে তো তার রূপ ছিল মুনি-ঋষিদের মনভোলানোর মতন। তবু যে যথাসময়ে তার বিয়ে হয়নি তার একমাত্র কারণ, ঠিক ওইসময়েই, মানে অর্ণার যখন বাইশ বছর বয়েস, তখনই রতনবাবুর স্ত্রী মারা যান। 

মেয়ের বিয়ে নিয়ে মায়েদের যতটা চিন্তা থাকে অন্যদের তার সিকিভাগও থাকে না। এইজন্যেই মা-মরা মেয়েদের কপালে অশেষ দুর্গতি জমা থাকে। অর্ণার ক্ষেত্রেই বা অন্যরকম কিছু হবে কেন? রতনবাবু থাকতেন ব্যবসা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। মেয়ের বিয়ে দেওয়াটা যে একটা জরুরি কাজ সেটা তার খেয়ালই ছিল না। খেয়াল হল একদিন যখন দোকান থেকে অসময়ে বাড়ি ফিরে অর্ণাকে দেখলেন পাড়ার উঠতি হেক্কোড় বাসুদেবের গায়ে গড়িয়ে পড়তে। তাও আবার রতন জাটির নিজের বাড়ির বৈঠকখানায়। 

রতনবাবুদের পাড়াটা পুরোনো। বাসিন্দারা সবাই সবাইকে চেনে। পাশের বাড়ির শিবিপিসিমা সেদিন ইশারায় রতনবাবুকে ডেকে গলায় নিমফুলের মধু ঢেলে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে যা বলেছিলেন তার সহজ অর্থ দাঁড়ায়—তোমার মেয়ে বেটাছেলের ছোঁয়া পাবার জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে রতন। ওকে যেভাবে হোক পার করো। 

শিবিপিসিমার কথাটা শুনে গা রি-রি করে উঠলেও সেটাকে সত্যি বলে বুঝতে অসুবিধে হয়নি রতন জাটির। সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। দশবছর আগে অর্ণার বিয়ে দেওয়াটা যেমন সহজ ছিল, আজ দশবছর বাদে তা ততটাই কঠিন। অর্ণার বয়স বেড়ে গেছে। দোজবরে ছাড়া তার সঙ্গে মানানসই পাত্র পাওয়া মুশকিল। তার চেয়েও বড় কথা রতনবাবুর ট্যাঁক একদম গড়ের মাঠ। মেয়ের বিয়ে, তাও বয়স্থা মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে যে পরিমাণ টাকাপয়সা লাগে, তাকে বিক্রি করে দিলেও আজ সে পয়সা আসবে না।

তাহলে উপায়?

গ্যালাক্সি স্টুডিয়োতে দু-চারজন লোকের এখনো যাতায়াত রয়েছে। তারা অ্যান্টিক ক্যামেরার কালেকটর। নিজেদের কালেকশনের পঞ্চাশ ষাট সত্তর আশি বছরের পুরোনো দুষ্প্রাপ্য সব ক্যামেরাকে সচল রাখার জন্যে তারা রতন জাটির কাছে আসেন। সেরকমই একজন হলেন উত্তরপাড়ার মিলনকৃষ্ণ মুখুজ্জে। বয়সে রতনবাবুর থেকে অনেক ছোট—এই চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর হবে। কিন্তু রতনবাবুকে নাম ধরে তুমি বলে ডাকেন। ঘুণধরা জমিদার বাড়ির ছেলে, তবে এখন জমিদারির বদলে প্রোমোটারি আছে। দুটো অফ-শপ মদের দোকানও আছে। রমরমা বিক্রি। মদ মেয়েছেলে কোনো কিছুতেই মিলনকৃষ্ণের অনাসক্তি নেই। 

রিসেন্টলি মিলনকৃষ্ণ মুখুজ্জে হাতিবাগানে একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন। সেটা জমিদারদের বাগানবাড়ির আধুনিক বিকল্প। ওখানেই মিলনকৃষ্ণ আজকাল বেশিরভাগ সময় কাটান। সেই ফ্ল্যাটে রতনবাবু যেমন গিয়েছেন, মিলনকৃষ্ণও কয়েকবার রতনবাবুর বাড়িতে এসেছেন। 

পুরোনো পরিচিত হিসেবে তার কাছেই একদিন কথায় কথায় রতনবাবুর মনের দুঃখ, মনের চিন্তাগুলোর কথা বলে ফেলেছিলেন। মিলনকৃষ্ণ শুনেই বললেন, ছি ছি ছি রতন। আমাকে আগে বলবে তো। কলকাতায় থাকো, পা বাড়ালেই অমন চমৎকার রেসের মাঠ। এখানে কেউ টাকাপয়সার অভাবের কথা বলে? টাকা এখানে ডিম পাড়ে। চলো, আজই চলো।

সেদিন সত্যিই রতন জাটি মিলনকৃষ্ণের সঙ্গে রেস খেলতে গিয়েছিলেন এবং দুশোটাকা লাগিয়ে পঁচিশশোটাকা জিতেছিলেন। পরের দিনও মিলনকৃষ্ণের সঙ্গেই মাঠে গিয়েছিলেন এবং হাজারটাকা লাগিয়ে আটহাজার টাকা জিতেছিলেন। 'বিগিনারস লাক' কথাটা রতন জাটির জানা ছিল না। 

পরের শনিবার রতনবাবু একাই রেসের মাঠে গিয়েছিলেন। মাঠে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে সবেমাত্র তার আগের দিনই বহু পুরোনো একটা জার্মান ক্যামেরা এক কালেকটরকে পঁচিশহাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেই পুরো টাকাটা পকেটে নিয়েই সেদিন রতন জাটি মাঠে ঢুকেছিলেন এবং পঁচিশহাজারই হেরেছিলেন। 

এসব ক্ষেত্রে হারা-টাকা উশুল করার একটা রোখ চেপে যায়। রতনবাবু সেই দশার মধ্যে ছ'মাস কাটিয়ে যখন ফের ধাতস্থ হলেন ততদিনে তার অস্থাবর সম্পত্তি শূন্যের ঘরে এসে ঠেকেছে। তার মধ্যে সবক'টা পুরোনো আমলের অ্যান্টিক ক্যামেরা আর তার মৃতা স্ত্রীয়ের গয়নাগুলোও ছিল মানে যে গয়নাগুলো দিয়ে তিনি অর্ণার বিয়ে দেবেন বলে ভেবেছিলেন। 

এরপর আর তিনি মাঠমুখো হননি। ওই একটু আগে যেমন বলেছি, বারোটা থেকে আটটা পর্যন্ত চুপচাপ দোকানের কাউন্টারে বসে থেকে বাড়ি ফিরে যেতেন। 


দুই


এই সময়েই একদিন সন্ধে সাতটা-সাড়ে-সাতটা হবে, রতনবাবু সবে দোকানে ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ি ফেরার কথা ভাবছেন হঠাৎ একটা সিড়িঙ্গে মতন লোক এদিক ওদিক তাকিয়ে সুট করে দোকানের ভেতর ঢুকে পড়ল। 

লোকটা তার মাথায় মুখে জড়িয়ে রাখা ক্যাটকেটে লাল রঙের মাফলারটা খুলবার পর রতনবাবু দেখলেন তার বয়স বেশি নয়। তেল চুপচুপে চুল, চড়িয়ে ভাঙা গাল, কুতকুতে চোখ আর পানের রসে ভিজে ঠোঁট দেখলে বলে দিতে হয় না যে ব্যাটাচ্ছেলে বিহারি। বোধহয় কোনো বড়লোকের বাড়ির ড্রাইভার কি চাকর হবে। ছেলেটার প্রথম কথাতেই রতনবাবু নিশ্চিত হলেন যে, তার অনুমান ঠিক। ছেলেটা ফ্যাসফেসে গলায় বলল, কাকু, থোড়া অন্দর চলিয়ে না। 

দোকানের পেছনদিকে আরেকটা ছোট ঘর রয়েছে, যেটা তিনি ক্যামেরা সারানোর কাজের সময় ব্যবহার করেন। সেদিকেই চোখের ইশারা করল ছেলেটা। 

রতনবাবু পোড় খাওয়া লোক। এইধরনের ছেলে-ছোকরা দোকানে কী মতলবে আসে তা তার অজানা নয়। তিনি দ্বিরুক্তি না করে ছেলেটাকে নিয়ে পেছনের ঘরে ঢুকলেন, তারপর কোনো ভূমিকা ছাড়াই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে উত্তর কলকাতার মার্কামারা ঘটি-হিন্দিতে বললেন, দিখাও তো দেখি, কেয়া লায়া হ্যায়। 

সেই ছেলেটাও চট করে রতনবাবুর হাতে একটা ক্যামেরা তুলে দিল। রতনবাবু আলোর নীচে ক্যামেরাটাকে একবার দেখেই একটা হেঁচকি তোলার মতন আওয়াজ করলেন। ক্যামেরা নিয়ে তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। এ জিনিসের কথা শুনেছেন অনেক, ফোটোগ্রাফির বিদেশি ম্যাগাজিনে ছবিও দেখেছেন কয়েকবার। কিন্তু চর্মচক্ষে দেখার সুযোগ আগে কখনো হয়নি। হবে কেমন করে? রতনবাবু যতদূর জানেন, গোটা ওয়েস্ট-বেঙ্গলের এবং সম্ভবত গোটা ইন্ডিয়ার কোনো ক্যামেরা-কালেকটরের কাছে এই জিনিস নেই। 

সেটা ছিল পোলারয়েড কর্পোরেশনের প্রথম যুগের একটা ইনস্ট্যান্ট ক্যামেরা। এই ক্যামেরায় শাটার টেপার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছবি প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসে। ক্যামেরাটা যে খুব দামি তা কিন্তু নয়। বরং উলটো। এগুলো ছিল একেবারে সস্তার ক্যামেরা। আজকের ভাষায় বলতে গেলে 'ইউজ অ্যান্ড থ্রো'। 

এই মডেলের ক্যামেরার পেটের ভেতরে মোট কুড়িটা ছবি তোলার মতন ফিল্ম ভরা থাকত। নতুন করে আর ফিল্ম ভরা যেত না। কুড়িটা ইনস্ট্যান্ট ফোটো হাতে এসে গেলেই ক্যামেরাটার কাজ শেষ। তখন সেটা ওয়েস্টবিনে ফেলে দিয়ে ছবিগুলো নিয়ে বাড়ি চলে যাও —এই ছিল আইডিয়া। ও হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। অতদিন আগেও ক্যামেরাটায় রঙিন ছবি উঠত। 

আমেরিকান ট্যুরিস্টদের মধ্যে ক্যামেরার ওই মডেলটা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। বিদেশি ম্যাগাজিনে ওই মডেলের ক্যামেরায় তোলা বেশ কিছু ছবি রতনবাবু দেখেছেন। সবই প্রায় সি-বিচের ছবি। স্বল্পবসনা সুন্দরীদের ছবি। বিয়ার-মাগ হাতে নিয়ে উচ্ছল যুবকদের ছবি। হাইওয়ের ধারে দামি গাড়িতে জার্নির সময়ে তোলা ছবিও দেখেছেন কয়েকটা। 

রতনবাবু জানতেন, ক্যামেরাগুলো ফেলে দেওয়া হত বলেই সেগুলো আজ এত দুর্লভ। সেরকম একটা দুর্লভ ক্যামেরাই এই ছোকরা আজ তার কাছে নিয়ে এসেছে। কোথা থেকে সে এটা পেল সেকথা জিগ্যেস করলেন না রতনবাবু। চোরাই মালের কারবারে ওরকম প্রশ্ন করার নিয়ম নেই। বরং গলায় যতদূর সম্ভব উদাসীনতা মাখিয়ে জিগ্যেস করলেন, ছোকরা এটার জন্যে কত দাম আশা করে? 

কাকু, ইয়ে কিমতি চিজ হ্যায়। হাজার রুপৈয়াকে নীচে নেহি মিলেগা। 

 রতনবাবু আবার একটা হেঁচকি তুলতে যাচ্ছিলেন। কোনোরকমে সামলালেন। এ ছোঁড়ার তো দাম সম্বন্ধে কোনো আইডিয়াই নেই দেখা যাচ্ছে। যাই হোক, মনের খুশি মনে চেপে রেখে তিনি বললেন, দাঁড়া বাবা। পহেলে এক প্রিন্ট লেকে দেখতা হ্যায় চলছে কি না। রতনবাবু ক্যামেরার ফিল্ম-কাউন্টারের কাছে চোখ নিয়ে গিয়ে দেখলেন নম্বর দেখাচ্ছে ১২। তার মানে এগারোটা ছবি তোলা হয়ে গেছে। কুড়িটার মধ্যে ন'টা ফিল্ম তখনো অবশিষ্ট আছে। তিনি দোকানের সামনের রাস্তাটার দিকে তাকালেন। জনমানবহীন রাস্তা। একটা নেড়ি কুকুর অবধি কোথাও নেই। তবে উলটো দিকে ইট বার করা বাড়িটা আছে। হ্যালোজেন আলোর ল্যাম্পপোস্ট আছে। একটা ঠেলাগাড়ি দাঁড় করানো আছে। এগুলোর ছবি যদি আসে তাহলেই বোঝা যাবে ক্যামেরাটা কাজ করছে। রতনবাবু ফাঁকা রাস্তার দিকে তাক করে শাটার টিপলেন।

আধ মিনিটের মধ্যেই দিব্যি স্মুদলি একটা প্রিন্ট বেরিয়ে এল। 

ফোটোটা দেখে রতনবাবুর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন ক্যামেরাটার ওপর সময় তার দাঁত বসিয়েছে। ফোটোটা বেশ ঝাপসা এসেছে। তাছাড়া ওটার ঠিক মাঝখানে কীসব ছায়া ছায়া মতন দাগও পড়েছে। তবে রতনবাবু জানতেন তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ, এ ক্যামেরা তিনি যাকেই বিক্রি করুন সে তো আর ছবি তুলবার জন্যে কিনবে না। জাস্ট জিনিসটা নিজের অধিকারে রাখবার জন্যেই কিনবে। এবং রতনবাবুর আন্দাজ এটা বিক্রি করে তিনি হাজার পঞ্চাশেক টাকা অনায়াসেই পেয়ে যাবেন। 

তবু তিনি প্রিন্টটা বিহারি ছোকরার চোখের সামনে ধরে বললেন, দেখো। কিতনা বাজে পিকচার আয়া হ্যায়। ইয়ে গন্ধা মাল হ্যায়। ইসকে লিয়ে তুমকো হাম পাঁচশো রুপিয়া দেগা।

ছেলেটা বেশ ঝুলোঝুলি করছিল। শেষমেষ সাতশো টাকা দিয়ে রতনবাবু ক্যামেরাটা রেখে দিলেন। 

সেদিন দোকান থেকে বেরোতে রতনবাবুর স্বাভাবিকভাবেই একটু দেরি হয়ে গেল। তিনি তার ওয়ার্কশপে বসে নতুন সম্পদটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা ভাবে পরীক্ষা করে দেখছিলেন। হঠাৎ মেঘ ডাকার শব্দে তার চমক ভাঙল। পরক্ষণেই আকাশ ভেঙে অসময়ের বৃষ্টি নামল। রতনবাবু মনে মনে বললেন, আজ ভোগাবে।

বৃষ্টি পড়েই চলেছিল। রতনবাবু দোকানের কাউন্টারে বসে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়েছিলেন। প্রবল বৃষ্টিতে সবকিছু ঝাপসা দেখাচ্ছিল। তার মধ্যেই একটা পরিবার ভিজতে ভিজতে গ্যালাক্সি স্টুডিয়োর এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল। বাবার কোলে একটা বছর তিনেকের ছেলে। মায়ের হাত ধরে বছর পাঁচেকের ফ্রক পরা মেয়ে। রতনবাবু আপনমনে বলে উঠলেন, ছবির মতন। 

নিজের ওই কথাটা তার নিজের কানেই ভীষণ জোরে ধাক্কা মারল। তিনি আবার নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলেন, 'ছবির মতন?' তার চোখ দুটো বিস্ময়ে গোল গোল হয়ে উঠল। তিনি ড্রয়ার থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে চোখে লাগিয়ে একটু আগে তোলা সেই ছবিটার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। কোনো সন্দেহ নেই, ছবিটাতে এখনকার এইমুহূর্তের বৃষ্টির দৃশ্য ধরা পড়েছে। ল্যাম্পপোস্ট, ঠেলাগাড়ি, ইট বার করা দেয়াল—সবকিছুর ওপরেই জলের ভারী পর্দা। সেইজন্যেই সবকিছু এমন ঝাপসা লাগছে। তাছাড়া মাঝের ওই কালো দাগগুলো সাধারণ দাগ নয়। বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া পরিবারটার ছবি, ওই একটু আগে যারা দোকানের এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল। সেই বাবার কোলে ছেলে, মায়ের হাত ধরে মেয়ে। না, কোনো ভুল নেই। 

কিছুক্ষণ পরে যা হবে তার ছবি এই আশ্চর্য-ক্যামেরা আগেই ফিল্মের ওপর ধরে রেখেছে। 


তিন


পরদিন ভোরবেলায় রতন জাটি ক্যামেরাটা নিয়ে নিজের বাড়ির ছাদে উঠলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে ঠিক পাশের বাড়ির ছাদটার দিকে তাক করে শাটার টিপলেন। তার পরেই ঘড়িটা দেখে নিলেন। ছ'টা বাইশ। 

ছ'টা বেজে সাড়ে-বাইশ মিনিটে পোলারয়েড ক্যামেরা থেকে প্রিন্ট বেরিয়ে এল। ছবিতে পাশের বাড়ির ছাদ, চিলেকোঠা, কাপড় মেলবার তার, পাঁচিলের ওপর তুলসীগাছের টব সবই রয়েছে। বেশ পরিষ্কারভাবেই রয়েছে। উপরন্তু তাও রয়েছে যা এই মুহূর্তে নেই। রয়েছে এক মাঝবয়সি গিন্নিবান্নি চেহারার মহিলার ছবি। তিনি কামানের গোলার মতন তুঙ্গ দুই বুকে একটা ঠেঁটি গামছা জড়িয়ে, তারে ভিজে ব্লাউজ মেলছেন। 

রতনবাবু অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বাদে সত্যিই সেই সিক্তবসনা মহিলা বুকে ভেজা গামছা জড়িয়ে, কাচা কাপড়ের বালতি হাতে নিয়ে ছাদে উঠে এলেন। প্রতিবেশী হিসেবে রতনবাবু ওই মহিলাকে বিলক্ষণ চেনেন। পাশের বাড়ির কানাই শিকদারের পুত্রবধূ। ভারি দজ্জাল। 

মহিলা রতনবাবুকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে কাপড় মেলতে শুরু করলেন। যখন ঠিক সেই ফোটোর সিচুয়েশনটা এলো, মানে সায়া শাড়ি ইত্যাদি মেলে দেওয়ার পরে মহিলার হাতে লাল রঙের ব্লাউজটা উঠে এল, তখনই রতনবাবু আবার ঘড়ি দেখলেন। ছ'টা বেজে বাহান্ন মিনিট। রতনবাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি ঘোরলাগা দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে চকিত সুখের হাসি। এ-ও কি সম্ভব? ঠিক আধঘণ্টা পরে যা হবে তার ছবি তুলে রেখেছে তার আশ্চর্য ক্যামেরা! 

কিন্তু সেই সুখের ঘোর বেশিক্ষণ রইল না। পাশের বাড়ির ছাদ থেকে বেশ স্পষ্ট উচ্চারণে কয়েকটা বাক্য ভেসে এল।—আ মরণ! ঘাটে যাবার বয়স হল তবু মেয়েছেলে দেখার শখ মিটল না! ওইজন্যেই বউটা মরে বেঁচেছে। 

জ্বালাময়ীর কথার জ্বালায় হুঁশ ফিরে পেয়ে রতনবাবু ক্যামেরা বুকে জড়িয়ে দুড়দাড় করে নীচে নেমে এলেন। 

সেদিন তিনি আর দোকানে গেলেন না। অনেকদিন বাদে মোড়ের তেওয়ারির দোকান থেকে কচুরি আর জিলিপি কিনে আনলেন। স্নানের সময় অনেকদিন বাদে পরিষ্কার করে নতুন ব্লেডে দাড়ি কামালেন। আলমারি থেকে ধোপদুরস্ত ইস্ত্রি করা প্যান্টশার্ট বার করে পরলেন, সে-ও অনেকদিন বাদে। অর্ণা পুরো সময়টাই অবাক হয়ে বাবাকে দেখছিল। বাবা যখন ভাত খেতে বসে ঠিকে-রাঁধুনি রমলাদির রাঁধা ছ্যারছেরে মুসুরডালের প্রশংসা করে বসল, তখন সে আর না পেরে জিগ্যেস করল, কোথায় যাচ্ছ বাবা?

একটু ইয়ের দিকে যাচ্ছি মা, মানে অ্যাকাডেমিতে একটা ফোটোগ্রাফির এগজিবিসন আছে। বিবেক...বিবেক ব্যানার্জি। ভারি ভালো ছবি তুলছে ছেলেটা। একটু দেখে আসি। তুমি সাবধানে থাকবে। বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেবে না, কেমন? 

গলির মোড় থেকে একটা ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়লেন রতন জাটি। বললেন, চলো রেসকোর্স। 

রেসের মাঠে পৌঁছিয়ে রতনবাবু দেখলেন তখনো রেসুড়েরা কেউই প্রায় এসে পৌঁছোয়নি। কেনই-বা আসবে? রেস শুরু হতে তখনো তো প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরি রয়েছে। রতনবাবু আরাম করে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল নিয়ে গ্যালারিতে উঠে বসলেন এবং বোতলে চুমুক দিতে দিতে রেসের বইটা খুলে দেখতে শুরু করলেন সেদিন কোন কোন ঘোড়া দৌড়চ্ছে, কোন ঘোড়াকে চালাচ্ছে কোন জকি, কোন ঘোড়া কোন লেনে দৌড়চ্ছে ইত্যাদি।

রেস শেষ হবার সময়টা তার জানা ছিল। বিকেল চারটে বেজে কুড়ি মিনিট। ঠিক তার আধঘণ্টা আগে রতনবাবু ফিনিসিং-পয়েন্টের কাছাকাছি গিয়ে খালি মাঠটার দিকে তাক করে ক্যামেরার শাটার টিপলেন। যথারীতি সড়সড় করে একটা ফোটোর প্লেট বেরিয়ে এল। বলাই বাহুল্য সেই ফোটোয় মাঠটাকে খালি দেখাচ্ছে না। বরং দেখাচ্ছে এক তীব্র উত্তেজনাময় ছবি—আটটা ঘোড়া এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের এদিকে ওদিকে ফিনিশিং-লাইন টাচ করছে। ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রথম ফিনিশিং-লাইন পেরোচ্ছে তিননম্বর লেনের ঘোড়া। 

রতনবাবু পকেট থেকে রেসের বইটা বার করে আবার পাতা ওলটালেন। এই রেসে তিননম্বর লেনে দৌড়বে মর্নিং-গ্লোরি নামে ঘোড়াটা। বই থেকেই দেখা যাচ্ছে ঘোড়াটা আগে কখনো এরকম বড় রেসে দৌড়য়নি, জেতা তো দূরের কথা। সেইজন্যেই মর্নিং-গ্লোরির দর দশে এক। অর্থাৎ কেউ যদি মর্নিং-গ্লোরির নামে এক টাকা লাগায়, সে মর্নিং-গ্লোরি জিতলে পাবে দশটাকা। 

রতনবাবু পকেট থেকে পাঁচশো টাকা বার করে বুকিং কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালেন। 

রেস শেষ হল। মর্নিং-গ্লোরিই জিতল। রতনবাবু থুতু দিয়ে পাঁচহাজার টাকা গুনে নিলেন এবং পুরো টাকাটা নিয়েই আবার বুকিং-কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালেন। আশ্চর্য-ক্যামেরার কল্যাণে ততক্ষণে পরের রেসের বিজয়ী ঘোড়ার নামটাও তার জানা হয়ে গেছে। বাবা মুস্তাফা। 

বাবা মুস্তাফার দর ছিল একে আট। পাঁচহাজার টাকা লাগিয়ে রতন বাবু পেলেন আটগুণ টাকা, মানে চল্লিশ হাজার টাকা। অর্থাৎ রতনবাবু সেদিন পাঁচশো টাকা নিয়ে রেসকোর্সে ঢুকেছিলেন, কিন্তু বেরোলেন চল্লিশহাজার টাকা নিয়ে। 

বাড়ি ফেরার পথে রতনবাবু একবার ভাবলেন মেয়েটার জন্যে কয়েকটা জিনিস কিনে নিয়ে যাবেন। অর্ণা বাড়িতে যে নাইটি না কি পরে ঘোরে, সেটার পিঠের কাছটা ছিঁড়ে গিয়েছে। তাছাড়া কাল রাতেই মেয়েটার ঘর থেকে সারারাত ফটফট করে মশা মারার আওয়াজ আসছিল। বেচারার মশারিটা চোদ্দো জায়গায় ফেঁসে গিয়েছে। একটা মশারি কিনলেও হয়। মা-মরা মেয়েটার জন্যে কতদিন কিছু কিনে নিয়ে যাননি।

কিন্তু শেষ অবধি কিছু কিনলেন না রতনবাবু। খালি হাতেই বাড়ি ঢুকলেন। যতক্ষণ আশ্চর্য-ক্যামেরায় ফিল্ম রয়েছে ততক্ষণ প্রত্যেকটা টাকার দশগুণ হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এখন টাকাগুলোকে হাতে রাখতে হবে। এরকমটাই ভাবলেন রতনবাবু। 

পরের শনিবারেও তিনি রেসের মাঠে গেলেন। রেস শেষ হবার ঠিক আধঘন্টা আগে আশ্চর্য-ক্যামেরায় ফিনিশিং-লাইনের ছবি তুললেন এবং যথারীতি বিজয়ী ঘোড়ার পরিচয় জানতে পারলেন। সেদিন দুটো রেসে রতনবাবুর চল্লিশ হাজার টাকা ফুলে ফেঁপে হয়ে উঠল তিনলাখ সত্তরহাজার টাকা। ক্যাশ। রতনবাবু পুরো টাকাটাই পরের শনিবারের জন্যে তুলে রাখলেন। শুধু পাড়ার দোকান থেকে দুটো ডিম কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। অর্ণাকে বললেন—রাতে ডিমের ডালনা করিস। রুটি আর ডিমের ডালনা, অনেকদিন খাইনি। 

অর্ণা যখন চলে যাচ্ছে তখন রতনবাবু দেখলেন ওর গায়ে একটা নতুন নাইটি। পরদিন ভোরে মেয়ের ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন, নীল নেটের নতুন মশারির মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে অর্ণা। রতনবাবুর মনে সন্দেহ জাগল—অর্ণা কি তার তবিল থেকে টাকা সরাচ্ছে?


চার 


পরের শনিবার রতন জাটি রেসের মাঠে গেলেন তিন লাখ সত্তর হাজার টাকা পকেটে নিয়ে। পোলারয়েড ক্যামেরার ছবি দেখে তার মনে হয়েছিল চার নম্বর লেনের ঘোড়া টমবয় উইনার। তিনি টমবয়ের ওপরে পুরো টাকাটাই লাগিয়ে দিলেন।

এবং পুরো টাকাটাই হারলেন। 

বোর্ডে উইনারদের নাম টাঙিয়ে দেওয়ার পর রতনবাবু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। উইনার টমবয় নয়, রাজাসাহেব বলে অন্য একটা ঘোড়া।

তার পায়ের তলার মাটি টলমল করছিল। তিনি আকাশপাতাল হাতড়ে একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। এটা কেমন করে হল? কী করে হল? ক্যামেরা তো এর আগে কখনো ভুল করেনি।

গ্যালারির এক কোনায় বসে রতনবাবু পকেট থেকে শেষ ছবির প্রিন্টটা বার করে সেটার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। কিছুক্ষণ দেখার পরে তার মনে হল তিনি বোধহয় ভুলটা ধরতে পেরেছেন। হ্যাঁ, ক্যামেরার নয়, তারই ভুল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সবক'টা ঘোড়াই ফিনিশিং-লাইন পেরিয়ে গেছে এবং তাদের সবার আগে রয়েছে টমবয়। তার ঠিক পেছনেই রাজাসাহেব স্প্রিন্ট করছে। কিন্তু ফিনিশিং লাইনে নিশ্চয় রাজাসাহেবই সবার আগে পৌঁছেছিল, টমবয় তখন ছিল পেছনে। তার পরে, ফলো-থ্রুতে টমবয় তাকে টপকে গেছে। কিন্তু তাতে তো কিছু আসে যায় না। উইনার রাজাসাহেবই।

তিনি ফিনিশিং-লাইনের পরের ছবি দেখে বাজি ধরেছেন। উচিত ছিল ফিনিশিং লাইনের ঠিক আগের ছবি দেখা। তার ক্যামেরার শাটার টিপতে এক সেকেন্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল, আর তাতেই এই বিপত্তি।

কিন্তু এখন কী করা যায়? রতনবাবু ক্যামেরার ফিল্ম-কাউন্টারের দিকে তাকালেন। ১৯ সংখ্যাটা জ্বলজ্বল করছে। তার মানে আর দুটো মাত্র ফিল্ম অবশিষ্ট রয়েছে। এই দুটো ফিল্মে তিনি কতটা ভাগ্য ফেরাতে পারেন? এই মুহূর্তে তার পকেটে ষাট-সত্তর টাকা পড়ে আছে। সেই টাকা নিয়ে খেলা শুরু করা যায় নাকি? 

আমজনতার জন্যে মাঠের এককোনায় জলের ট্যাপ রয়েছে। সেখানে গিয়ে রতনবাবু অনেকক্ষণ ঘাড়ে মাথায় জল থাবড়ালেন। তারপর মাথাটা একটু ঠান্ডা হলে রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্রাম ধরে হাতিবাগানের দিকে চললেন। গন্তব্য মিলনকৃষ্ণ মুখুজ্যের বাড়ি। তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন। এই আশ্চর্য ক্যামেরা তিনি বিক্রি করে দেবেন, অবশ্যই এর আশ্চর্য ক্ষমতার কথা না জানিয়ে। শুধু এক অসামান্য অ্যান্টিক হিসেবেই এটার জন্যে তিনি পঞ্চাশ হাজার টাকা পেতে পারেন। তারপর সেই টাকা আর শেষ দুটো ফিল্ম নিয়ে আরেকবার ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখবেন।

তার জন্যে অবশ্য মিলনবাবুর কাছে একটা আবদার করতে হবে। ওনাকে বলতে হবে ক্যামেরাটা তিনি ওনাকে হ্যান্ড-ওভার করবেন এক সপ্তাহ বাদে, মানে পরের শনিবার রাতের দিকে। এতদিনের চেনা লোক, এইটুকু মেনে নেবেন নিশ্চয়ই। 

স্টার থিয়েটারের পেছনদিকের গলিতে মিলনকৃষ্ণের ফ্ল্যাটটা নতুন এবং বিশাল। সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে মিলনকৃষ্ণের দরজার কলিংবেলের সুইচে চাপ দিলেন। দরজা খুলে মিলনকৃষ্ণ এতটাই চমকে গেলেন যে রতনবাবু তো অবাক। একথা ঠিকই যে তার আসার কথা ছিল না। মোবাইলে হয়তো আগে একটা খবর দিয়ে আসা উচিত ছিল, সেটাও তিনি দেননি। কিন্তু তাতে এত চমকাবার কী আছে? শুধু চমকে যাওয়া নয়, মিলনকৃষ্ণ যেন তাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন বলেই মনে হল রতনবাবুর। 

অবশ্য সামলেও নিলেন খুব তাড়াতাড়ি। ঘরে ঢুকিয়ে বললেন, খুব অসময়ে এসেছ হে রতন। আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে। হাতে পাঁচমিনিটও সময় নেই। যা বলবার তাড়াতাড়ি বলে ফেল। 

ডাঁহা মিথ্যে কথা—মনে মনে ভাবলেন রতনবাবু। কোত্থাও বেরোবার কথা নেই মিলনকৃষ্ণের। ব্যাটা সিল্কের ফতুয়া আর বাটিকের লুঙ্গি পরে বসে আছে। মিউজিক সিস্টেমে গজল বাজছে। ওদিকে কর্নার টেবিলে ভদকার বোতল, লাইম কর্ডিয়াল, কাজুর প্লেট। পুরোপুরি ছুটির মুডে রয়েছে মিলনকৃষ্ণ। তাহলে তাকে এত তাড়াতাড়ি ভাগাতে চাইছে কেন? হয়তো বিজনেসের ব্যাপারে কোনো লোক-টোক আসবে। আন্ডার-হ্যান্ড ডিল হবে। যাগগে, এখানে বেশিক্ষণ সময় কাটাবার ইচ্ছে রতনবাবুরও নেই। তিনি কাঁধের শান্তিনিকেতনী ঝোলা থেকে ক্যামেরাটা বার করে মিলনকৃষ্ণের দিকে এগিয়ে দিলেন।

মিলনকৃষ্ণের মতন বুঝদার খরিদ্দারদের নিয়ে সুবিধে এটাই যে, তাদের কাছে ক্যামেরার পেডিগ্রি নিয়ে বেশি কিছু বলতে হয় না। এই এখনই যেমন, ক্যামেরাটা একবার দেখেই ওনার চোখদুটো কপালের কাছাকাছি উঠে আবার নেমে এল। হাত বাড়িয়ে রতনবাবুর পিঠটা চাপড়ে দিয়ে বললেন, সাবাশ। বিক্রি করতে চাইছ?

রতনবাবু ঘাড় হেলালেন।

কত দেব?

রতনবাবু বললেন, আপনাকে আর কী বলব? এ জিনিসের দাম তো আপনি জানেন।

দাঁড়াও তাহলে। ক্যাশেই দিয়ে দিচ্ছি। ভেতরের ঘর থেকে হাজার টাকার নোটে দেড়লাখ টাকা নিয়ে এসে রতনবাবুর হাতে তুলে দিলেন মিলনকৃষ্ণ। বললেন, দামটা হয়তো এর থেকে একটু বেশিই হয়। কিন্তু আপাতত আমার কাছে এই আছে। পরে পুষিয়ে দেব। আচ্ছা তুমি এবার এসো। আমাকে তৈরি হতে হবে।

রতনবাবু পায়ে চটি গলাতে গলাতে কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেললেন তার আবদারটা। ক্যামেরাটা আর এক সপ্তাহ আমার কাছে থাকতে দিতে হবে স্যার। আর দুটো ফিল্ম রয়েছে, ও দুটো আমি তার মধ্যে খরচা করে ফেলব। 

মিলনকৃষ্ণ মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বললেন, থাক না, থাক না। তুমি তো আর পালাচ্ছ না। আর ছবিও তুলে নাও। তবে এত পুরোনো ফিল্ম। ছবি কি আর ঠিকঠাক আসবে? রতনবাবু ভাঙলেন না যে, ইতিমধ্যেই তিনি আঠারোটা ছবি তুলে ফেলেছেন এবং অভাবনীয় রেজাল্ট পেয়েছেন। 

আর কিছু বলবার সুযোগও ছিল না অবশ্য। এক হাতে ক্যামেরাটা রতনবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্য হাতে প্রায় তার মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করে দিলেন মিলনকৃষ্ণ। কেলেঙ্কারিটা হল ঠিক এই সময়েই। পাল্লার ধাক্কা থেকে ক্যামেরাটা বাঁচাবার জন্যে সেটাকে একটু তাড়াতাড়িই বুকের কাছে টেনে নিয়েছিলেন রতনবাবু। সেইসময়েই কেমন করে যেন শাটারের ওপর তার হাত পড়ে গেল। একপলকে জ্যান্ত হয়ে উঠল ক্যামেরার ভেতরের কলকবজা। তার মুখের ওপর দরজাটাও বন্ধ হল আর সঙ্গে সঙ্গেই সড়সড় শব্দ করে বেরিয়ে এল উনিশ নম্বর ছবির প্রিন্ট। 

সিঁড়ির চাতালে দাঁড়িয়ে রতনবাবু দেখলেন সেই ছবি। আধখোলা দরজার ভেতর দিয়ে দেখা মিলনকৃষ্ণের বসার ঘর, যে ঘরটা তিনি এইমাত্র ছেড়ে এলেন। তবে এ ছবি তো এখনকার নয়, আরো আধঘণ্টা পরের। তাই এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে মিলনকৃষ্ণ মুখুজ্যে তার সোফার ওপরে একটা মেয়েকে চিত করে শুইয়ে মুখটাকে নামিয়ে আনছেন মেয়েটার মুখের ওপর। মেয়েটার হাসিহাসি মুখটা দরজার দিকে ফেরানো, তাই চিনতে অসুবিধে হয় না। সে রতনবাবুর আত্মজা—অর্ণা। 

ফোটোটাকে কুচি কুচি করতে করতে এমন একটা সময় এল যখন ছোট টুকরোগুলোকে আর নতুন করে ছেঁড়া যাচ্ছিল না। তখন রতন জাটি সেগুলোকে চাতালের দেয়ালের গায়ের ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে উড়িয়ে দিলেন। তারপর নেমে এলেন রাস্তায়।


পাঁচ


কোন রাস্তা ধরে কোনদিকে যে হাঁটছিলেন রতনবাবু কিছুই তিনি জানতেন না। যেন ঘুমের মধ্যে হেঁটে চলেছিলেন। শুধু একটা দুঃস্বপ্নের মতন মাথার ভেতর নড়াচড়া করছিল মিলনকৃষ্ণ আর অর্ণার সেই জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকা ছবিটা।

যখন হুঁশ ফিরল তখন তিনি গঙ্গার ধারে চক্ররেলের একটা স্টেশনে বসে আছেন। প্লাটফর্মের ওপাশেই স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক রোড। আর তার পরেই গঙ্গা। 

রতনবাবুর বুকের ভেতর সমস্ত যন্ত্রণার মধ্যেও কোথাও একজন ফোটোগ্রাফার চুপ করে বসেছিল। সে হঠাৎ বলে উঠল, বাঃ। 

রতনবাবু চমকে উঠলেন। 'বাঃ' মানে?

'বাঃ' নয়? দ্যাখো না বাঁদিকে রুপোর বিছের মতন হাওড়া ব্রিজ। শুনশান প্লাটফর্ম। রেললাইনের দুপাশে কত বুনোগাছ গজিয়েছে। কত প্রজাপতি উড়ছে। ভালো লাগছে না দেখতে?

রতনবাবু একটু ভেবে বললেন, লাগছে তো। 

সামনে তাকিয়ে দ্যাখো—গঙ্গার ওপাশে সূর্যাস্ত হচ্ছে। একটা সাদা ধবধবে মন্দির, বোধহয় হাওড়ার বাঁধাঘাটেই হবে, সূর্যাস্তের আলোয় গোলাপি হয়ে উঠেছে। নৌকার পালগুলোতেও রং ধরেছে। ঠিক ছবির মতন। ভালো লাগছে না তোমার?

রতনবাবু বিরসমুখে ফোটোগ্রাফারকে বললেন, লাগলেই বা কী?

'কী' মানে? ক্যামেরাটা তো তোমার কাছেই রয়েছে। একটা স্ন্যাপ নাও না। তার মধ্যে সবকিছুকেই ধরবার চেষ্টা করো। এই প্ল্যাটফর্ম, ওই নদী...।

না, হবে না।

কেন হবে না?

একটা বড় সমস্যা আছে। আমার এই ক্যামেরাটা একটু অদ্ভুত। এখন যদি শাটার প্রেস করি তাহলে আধঘণ্টা পরের ছবি আসবে। তখন তো সবকিছুর ওপর ছায়া পড়ে যাবে।

তা হোক না। তাতে হয়তো অন্যরকম একটা সৌন্দর্য ধরা পড়বে। অন্ধকার নেমে আসার ঠিক আগের মুহূর্তটাকে ভালোবাসো না তুমি?

বাসি, বাসি। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কাঁধের ঝোলা থেকে ক্যামেরাটাকে বার করে গলায় ঝোলালেন রতনবাবু। ফিল্ম-কাউন্টারের দিকে তাকালেন। ২০। শেষ ফিল্ম। নিজের অজান্তেই তার হাতটা একবার ছুঁয়ে এল ব্যাগের ভেতরে টাকার বান্ডিলটা। কত টাকা আছে যেন? দেড়লাখ, তাই না? আচ্ছা ক্যামেরাটার দাম কি এত বেশি হবে? না কি মিলনকৃষ্ণ এর মধ্যে অর্ণার মাংসের দামটাও ধরে দিল? ভাবলেন তিনি। 

রতনবাবুর বুকের ভেতর থেকে ফোটোগ্রাফার ধমকে উঠল—আবার ওইসব ডিপ্রেসিং কথাবার্তা নিয়ে ভাবছ? ওদিকে আলো যে পড়ে আসছে। শাটারটা টেপো।

রতনবাবু অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ফোকাস করলেন। তারপর আশ্চর্য-ক্যামেরায় শেষবারের মতন শাটার টিপলেন।

ছবিটা ভালোই এল। থেঁতলানো নখের মতন কালচে নীল আকাশ। তার গায়ে রক্তমেঘের দু-একটা লম্বা আঁচড়। নদীর বুকে নৌকায় নৌকায় আলো জ্বলে উঠেছে। ছবির ফ্রেমের একেবারে সামনে সূর্যের শেষ আলো মেখে শুয়ে রয়েছে দুটো রেল-লাইন আর তার ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ। মাথাটা ট্রেনের চাকার ধাক্কায় কোথায় যে ছিটকে গিয়েছে দেখা যাচ্ছে না। তবে লোকটার কাঁধের ঝোলাটা একটু দূরেই পড়ে রয়েছে। সেটার ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে একরাশ নোট। 

ছবিটা মন দিয়ে দেখতে দেখতে রতনবাবুর মুখটা হাসিতে ভরে উঠল। তিনি ফোটোগ্রাফারকে ডেকে বললেন, ওহে ওস্তাদ! এইজন্যে ছবিটা তোলার ব্যাপারে এত তাড়া দিচ্ছিলে? তুমি কি ভাবো, কিছুই জানি না? আমি কি এখানে এমনি এমনি এসেছি নাকি?


Comments