নিভাঁজ ত্রিভুজ - ঈশ্বরের নষ্ট ভ্রূণ - সৈকত মুখোপাধ্যায়

নিভাঁজ ত্রিভুজ

সৈকত মুখোপাধ্যায়


 আমার ছোটবেলায় পৌঁছোতে গেলে আজ থেকে পঞ্চাশবছর পিছিয়ে যেতে হবে। তখন এই বোষ্টমডাঙার চেহারাছবি কেমন ছিল তা আজকের বোষ্টমডাঙায় দাঁড়িয়ে কল্পনাও করা যাবে না। তখন কোথায় হাজারে-হাজারে অটো-টোটো, কোথায় বিগ-বাজার আর কোথায়ই বা গুচ্ছের ফ্ল্যাটবাড়ি? 

এই শহরের প্রত্যেকটা পাড়ায় তখন অনেকখানি করে ফাঁকা জমি পড়ে ছিল আর সেইসব জমির মধ্যে সদ্য তৈরি হচ্ছিল একটা-দুটো করে একতলা দোতলা বাড়ি। কাঁচা নর্দমার পাড়ে বর্ষায় নীলকলমি ফুটত। ফাঁকা জমিগুলোয় বিকেলে হাওয়াইচটির গোলপোস্ট বানিয়ে রবারের বল পিটত ন্যাংলা-প্যাংলা ছেলের দল। ছিল অনেক ডোবা আর পুকুর। বর্ষায় সেইসব পুকুরের উপচানো জলে চুনোমাছ ধরার জন্যে ঘুনি পাতত মালিকপাড়ার বস্তির রোগা মেয়েরা। সন্ধের পর থেকে ল্যাম্পপোস্টের মলিন বাল্বের আলোয় কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে থাকত চরাচর। শাঁখের শব্দ শুনে কাঁঠালবাগানের বিরাট অর্জুনগাছটার মাথা থেকে ডানা মেলে দিত বাদুড়ের ঝাঁক। 

আমার পিসির বাড়িটা ছিল অবশ্য অনেক পুরোনো। বোধহয় বোষ্টমডাঙার প্রাচীনতম বাড়ি ছিল সেটা। পিসেমশাই নিত্যানন্দ মজুমদারের বাবা শুদ্ধানন্দ মজুমদারের আমল থেকে ওরা ওই ভাঙাচোরা বাড়িটাতেই বাস করছেন। এই যে বোষ্টমডাঙা নিয়ে এত কথা বলছি, সে-ও ওই পিসির বাড়ির কল্যাণেই। এর মধ্যেও অনেকটাই আবার আমার পিসির শ্বাশুড়ি মেমবরণী দেবীর মুখে শোনা।

ছোটবেলায় যখন গরমের ছুটিতে পিসিমার বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, তখনো সে-বাড়িতে সিলিংফ্যান বসেনি। গরমের ঠেলায় অস্থির হয়ে মেমদিদার একতলার ঘরের পাথরের মেঝেয় মাদুরের বিছানায় শুয়ে দুপুর কাটাতাম। ঘরের কোনায় ঠাকুরের আসনের দিক থেকে চন্দন, তুলসী, বাসি ফুল, ভিজে-বাতাসা আর শসাকুচির ঠান্ডা ঠান্ডা গন্ধ ভেসে আসত। মেমদিদা পাশে শুয়ে ঝালর লাগানো হাতপাখা দিয়ে আমাকে হাওয়া করত। আমি অবাক হয়ে দেখতাম দিদার হাতের তালুর উলটো-পিঠের চামড়ার মধ্যে দিয়ে নীল নীল শিরা-উপশিরা দেখা যাচ্ছে। ভীষণ ফর্সা ছিল মেমবরণী মজুমদার—মেমেদের মতনই ফর্সা।

তবে কিনা তখন দিদার বয়স আশি পেরিয়েছে। ভীমরতির বশে বুড়ি কখন কী বলছে, কখন কী করছে, কিছুই ঠিক ছিল না। 

সেবার ক্লাস টেনের সামার-ভেকেশনে বোষ্টমডাঙায় গিয়ে দেখি, পিসিমা চেঁচিয়ে কুরুক্ষেত্র করছেন আর পিসেমশাই 'চুপ চুপ' বলে তাকে থামাবার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কী ব্যাপার? না, মেমদিদা পাশের পাড়ার চিন্তামুদির হাতে আফিং কেনার পয়সা দিতে গিয়ে ভীমরতির ঘোরে সিন্দুকে রাখা ভিক্টোরিয়ার মোহর তুলে দিয়েছে, যদিও চিন্তামনি সাহা জেরার মুখে বিলকুল সব অস্বীকার করে যাচ্ছে। 

হ্যাঁ, ভীমরতির ওপরে বুড়ির আফিং-এর নেশাও ছিল। দুইয়ে মিলে তাকে বানিয়ে তুলেছিল মহা কল্পনাপ্রবণ এক জীব। দিদা আমার পাশে শুয়ে নিজের মনেই যেসব গল্প বলে চলত, সেগুলোর মধ্যে দিয়েই আমার মতন এক বালকের চোখের সামনে প্রথম অন্ধকার পৃথিবীর আগল খুলে গিয়েছিল। কিম্বা বলা যায়—নরকের দরজার তালা। শিশু-মনস্তত্বের ধার ধারত না মেমদিদা। অবশ্য ক্লাস টেনে কেউ খুব একটা সরল-সিধে শিশু থাকে না। উপরন্তু আমি যে-স্কুলটায় পড়তাম, সেখানে বস্তির ছেলেপিলেদের সংখ্যাই বেশি ছিল। ফলে গুপ্তজ্ঞান বলতে যা বোঝায় তাতে আমার তখনই মাস্টারডিগ্রি হয়ে গিয়েছিল। 

আমি পাশে শুয়ে সেইসব কথার কিছুটা শুনতাম, কিছুটা গল্পের বইয়ের টানে হারিয়ে ফেলতাম।

তবে সে-প্রসঙ্গে দিদা কথা বলতে শুরু করলেই আমি বুকের ওপরে গোয়েন্দাগল্পের বই ভাঁজ করে রেখে কান খাড়া করে শুনতাম, সেটা হল কুট্টি নামে একটা মেয়ের গল্প। দিদার নিজের মেয়েরই ডাকনাম ছিল কুট্টি। তার যখন আঠেরো বছর বয়স তখন কারা যেন রেপ করেছিল। মেমদিদা 'রেপ' শব্দটার বদলে অত্যন্ত গ্রাম্য এবং স্ল্যাং একটা শব্দ ব্যবহার করত। তবে সেটা বুঝতে আমার অসুবিধে হত না। আগেই বলেছি, নারীপুরুষের শরীর ও সঙ্গম সংক্রান্ত সমস্ত স্ল্যাং-ই তখন আমার ঠোঁটস্থ ছিল। 

মেমদিদার ঘরের দেয়ালের দিকে চোখ চলে যেত। জোড়াবিনুনি বাঁধা একটা মেয়ের ফ্রেমে বাঁধানো সাদা-কালো ছবি ঝুলত সেই দেয়ালে। তার বাঁ-গালে আঁচিল। ছবিটা ঝুলত মেমদিদার হাতের নাগালেই, যাতে মেমদিদা প্রতিদিন ঠাকুরকে ফুল দেওয়ার সময়েই মেয়ের ছবিতে একটা টাটকা রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে দিতে পারে। 

যা বলছিলাম। তার মানে কুট্টি নামে সেই মেয়েটা ছিল আমার পিসেমশাই নিত্যানন্দ মজুমদারের দিদি। এরপর থেকে তাকে কুট্টিপিসি বলে রেফার করব। পূর্ববঙ্গের বরিশাল শহরের ধানকলের গলি নামে কোন এক অন্ধগলির মধ্যে নাকি একপাল নরপশু কুট্টিপিসিকে রেপ করেছিল। 

সেটা কবেকার কথা? মেমদিদার মুখে গল্পটা শুনেছিলাম আজ থেকে পঞ্চাশবছর আগে। তারও প্রায় পঞ্চাশবছর আগের সেই ঘটনা। তার মানে সেই ঘটনার পরে প্রায় একশো বছর কেটে গেছে। 

মেমদিদা বলত, মেয়েটা আমার তখন-তখনই মরেনি, বুঝলি গোপাল? মেয়েরা অত সহজে মরে না। যন্ত্রণা পেয়েছিল খুব। শরীরের যন্ত্রণা তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল ভয়। রাতে ঘুমোতে পারত না। দিনের বেলাতেও ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে, দেয়ালের কোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকত। আমি ছাড়া আর কেউ ঘরের বন্ধ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকবার চেষ্টা করলেই আতঙ্কে চিৎকার করতে শুরু করত। শেষ অবধি আমিই আর না পেরে তোর দাদুকে বললাম, চলো, অন্য কোথাও চলে যাই। এখানে থাকলে কুট্টি মরে যাবে। 

এই অবধি বেশ কয়েকবার শুনে ফেলার পরে যখন আমি কুট্টিপিসির গল্পে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলাম, ঠিক তখনই একদিন মেমদিদা আবার এমন একটা কথা বলে বসল যে, আমি মাদুর ছেড়ে খাড়া হয়ে বসলাম। মেমদিদা আফিঙের ঝিমুনির মধ্যে খুব ক্যাজুয়ালি বললেন, কুট্টির পেট হয়েছিল। 

এটা জানতাম যে, পেট হওয়া মানে প্রেগন্যান্ট হওয়া। রেপড হওয়ার সঙ্গে প্রেগন্যান্ট হওয়ার ব্যাপারটাকে জুড়ে নিতেও সময় লাগেনি। কিন্তু তারপর কী হল? বাচ্চা হয়েছিল নাকি কুট্টিপিসির? নাকি সেই বাচ্চা নষ্ট করে ফেলেছিল, নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? 

খাড়া হয়ে বসেই আমি মেমদিদাকে বললাম, বলো কি!

হ্যাঁ রে নাতি। ঠিকই বলছি। সে এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে পড়েছিল আমার মেয়েটা। পেটের মধ্যে বেড়ে উঠছে যে-বাচ্চাটা, তার ওপরে একদিকে যেমন কুট্টির ভীষণ ঘেন্না, আবার অন্যদিকে তেমনি মায়া। এবেলা যদি তাকে মারার জন্যে ইচ্ছে করে কলতলায় আছাড় খেয়ে পড়ে, তো ওবেলাই দেখি তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে চুরি করে দুধ খাচ্ছে। ওদিকে মেয়ের পেট ফুলে ওঠার পর থেকেই তো পাড়াপড়শিরা আড়চোখে তাকায়। ফুসুর-ফাসুর করে। আমাদের পক্ষে বরিশালে থাকা দায় হয়ে উঠল। 

তোর পিসেমশাইয়ের তখন পনেরোবছর বয়স, সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। ওকে বরিশালের বাড়িতে আমার ছোট জায়ের কাছে রেখে তোর দাদু আর আমি কুট্টিকে নিয়ে চলে এলাম এই বোষ্টমডাঙায়। 

কেন? এত জায়গা থাকতে হঠাৎ বোষ্টমডাঙায় কেন?—আমি জিগ্যেস করলাম মেমদিদাকে। 

মেমদিদার কথা ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। হাত থেকে খসে পড়ছিল হাতপাখা। কোনোরকমে বলল, এইখানে বাস করত একটা আধপাগলা লোক। সে আগে বরিশালে আমাদেরই প্রতিবেশী ছিল। পরে কলকাতার কলেজে চাকরি নিয়ে চলে আসে। পণ্ডিত লোক ছিল কিন্তু স্বভাবে হারামজাদা। কুট্টির ওই দুর্ভাগ্যের বছরখানেক আগে তার বউ মারা গিয়েছিল। লোকটা কুট্টির অবস্থা শুনে নিজেই তাকে বিয়ে করতে চাইল। আমরা তো হাতে চাঁদ পেলাম। ওইজন্যেই এখানে আসা। মাঘমাসের পূর্ণিমাতে কুট্টিকে জানোয়ারগুলো ভোগ করেছিল আর জৈষ্ঠমাসেই প্রফেসর চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে নমো নমো করে বিয়ে দিয়ে দিলাম তোর কুট্টিপিসির।

আমার গলা কেমন আঠা আঠা হয়ে গিয়েছিল। কোনোরকমে জিগ্যেস করলাম, উনি জানতেন যে...ইয়ে...কুট্টিপিসির পেটে বাচ্চা?

নিশ্চয় জানত। জেনেছিল বলেই তো বিয়ে করেছিল। ওর তো বউয়ের দরকার ছিল না। দরকার ছিল একটা মেয়ের গতর। পরে তো জানলাম, ওর আগের বউটাকেও পরীক্ষে-নিরীক্ষে করতে গিয়ে মেরে ফেলেছিল লোকটা। আমার কুট্টিকেও মারল। 

সেকী! আমার বিস্ময় বাঁধ মানছিল না। বেলগাছিয়া বস্তিতে শিখে-আসা সমস্ত পাকামো দিয়েও আমি নাগাল পাচ্ছিলাম না এক অবোধ্য হিংস্রতার। কোনোরকমে জিগ্যেস করলাম, মেরে লাভ কী হল? 

সে কথা আর শুনতে চাস না ভাই। শুনলে বিশ্বাসও হবে না তোর। শুধু এইটুকু বলে রাখি তোকে—কুট্টিকে যারা পোড়াতে নিয়ে গিয়েছিল, তারা বলেছিল ওর শরীরে কোনো যোনি ছিল না। যোনি বুঝিস তো? মেয়েদের যেখানে আদর করলে বাচ্চা হয়...।

আমি ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। একটু একটু বুঝতে পারছিলাম, কেন মেমদিদা জীবনের এতগুলো বছর আফিং-এর নেশায় বুঁদ হয়ে কাটিয়ে দিল আর কেনই-বা ওর স্বামী শুদ্ধানন্দ মজুমদার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। 


দুই


একটু বড় হওয়ার পর পিসিমার বাড়িতে যাতায়াত কমতে-কমতে প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল আমার। পিসেমশাই মারা গেলেন গত বছরে। পিসিমা তো তার পাঁচবছর আগেই মারা গিয়েছেন। পিসতুতো দাদা কমল ব্যাঙ্গালোরে ট্র্যান্সফার হয়ে যাওয়ার আগে আমার হাতে বোষ্টমডাঙার বাড়ির চাবি দিয়ে বলে গেল, গোপাল, মাঝে মাঝে একটু যাতায়াতের পথে বোষ্টমডাঙায় নেমে যাস। দরজা-জানলা খুলে হাওয়া খাইয়ে আসিস ঘরগুলোকে। নাহলে ড্যাম্প লেগে সব নষ্ট হয়ে যাবে। 

কমলদার কথায় আমি রাজি হয়ে গেলাম। ওই বাড়িটার সঙ্গে আমার অনেক নস্টালজিয়া জড়িয়ে রয়েছে। অনেক আদর, অনেক বই, অনেক পুরোনো গ্রামাফোন ডিস্কের গান। 

কমলদা চলে গেল এক সোমবার আর তার পরের রবিবারেই আমি দুপুরের দিকে বোষ্টমডাঙা স্টেশনে নেমে পড়লাম। একসময় পিসেমশাইয়ের হাত ধরে এই প্লাটফর্মে বেড়াতে আসতাম। অনেকক্ষণ বাদে-বাদে একটা করে এমু লোকাল প্রায় জনহীন প্লাটফর্মে দু-দশজন লোক নামিয়ে দিয়ে চলে যেত। আমি আর পিসেমশাই ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে দেখতাম, দূরে, লাইনের বাঁকে, হারিয়ে যাচ্ছে সেই ট্রেন। পশ্চিমে, ইটখোলার মাঠের ওদিকে, আকাশে আগুন ধরিয়ে সূর্য অস্ত যেত। প্লাটফর্মের কোল ঘেঁষে অনেকগুলো শিরীষগাছ ছিল। গ্রীষ্মের বিকেলে সেই শিরীষফুলের হালকা গন্ধ ভেসে আসত, যার সঙ্গে মেমদিদার গলা আর পিঠের পাউডারের গন্ধের কোনো তফাত পেতাম না।

আজ আর সেই প্লাটফর্মের কিছুই নেই। ভিড়ে ভিড়াক্কার প্লাটফর্ম। যেখানে একদিন শিরীষগাছের সারি ছিল, সেখানেই এখন রাশি-রাশি রোল-ঝালমুড়ি-লটারির দোকান। সূর্যাস্ত হারিয়ে গেছে বড় বড় হোর্ডিং-এর আড়ালে। আমি স্টেশন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেলাম মালিকপাড়ার সেই বাড়িটায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। সঙ্গে সঙ্গেই যেন টাইম মেশিনের কাঁটা উল্টোদিকে ঘুরে গেল।

সেই হিম ঠান্ডা ঘর, সেই আবছায়া দুপুর। বন্ধ ঘরের গুমোট বাতাসে কবেকার এক বালবিধবার প্রসাধনীর গন্ধ। মেমদিদার ঘরের দেয়াল থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আঠেরোবছরের এক মেয়ের জোড়াবিনুনি বাঁধা সাদাকালো ছবি। তার চোখের পাতা সুখস্বপ্নে ভারী, যেরকম সুখস্বপ্ন শুধু আঠেরো বছরের মেয়েরাই দেখতে পারে। তার বাঁ-গালে আঁচিল আর ছবির ফ্রেম থেকে ঝুলছে সাপের শিরদাঁড়ার মতন শুকনো রজনীগন্ধার একটা মালা।

অনেকদিন আগে এই ঘরের মেঝেতে শুয়েই আমি মেমদিদার মুখে শুনেছিলাম এক আশ্চর্য প্রলাপ। মেমদিদা বলেছিল, যেদিন ওরা মাত্র ছয়জন মিলে কুট্টিপিসিকে দাহ করতে শ্মশানে নিয়ে যায়, সেই রাতটা ছিল জন্মাষ্টমীর রাত। সে কী বৃষ্টি, সে কী বৃষ্টি! 

'ওরা' মানে শ্মশানবন্ধুরা। খবর পেয়ে আগে থাকতেই শ্মশানে মজুত ছিলেন পুরোহিত তুলসী ভট্টাচার্য। 

যেহেতু কুট্টিপিসি ছিল গর্ভিনী, কাজেই তুলসী ভট্টাচার্য বিধান দিলেন আগে গর্ভসংস্কার করে তারপর কুট্টিপিসির শবদেহ চিতায় তোলা হবে। সেইমতন শ্মশানবন্ধুরা কুট্টিপিসির শরীর থেকে কাপড় সরাতেই তাদের মাথায় বাজ পড়ল। তারা দেখল, যেখানে একজন নারীর যোনি থাকার কথা, সেখানে রয়েছে কেবল শীতল কঠিন মার্বেল-ফলকের মতন এক তিনকোনা পেশী। 

সেখানেই শেষ নয়। যোনিহীন কুট্টিপিসিকে দেখে শ্মশানবন্ধুর দল যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঠিক তখনই নাকি কুট্টিপিসির শরীরের এখান-ওখান থেকে চামড়া ফাটিয়ে বেরোতে শুরু করল একটা দুটো তিনটে চারটে গুঁটি। কমা-চিহ্নের মতন ঘিয়ে রঙের গুটিগুলোকে দেখে ওদের ছ'জনেরই কিছু একটা জিনিসের কথা মনে পড়েছিল। কিন্তু সেটা যে কী, তা ওরা পরেও কখনো বলতে পারেনি। যাইহোক, গুটিগুলো নাকি তারপর নিজেরাই শুঁয়োপোকার মতন বুকে হেঁটে শ্মশানের লাগোয়া খালের নরম মাটির মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিল। সেই দৃশ্য দেখে উন্মাদের মতন দৌড়ে পালিয়ে আসে ছজন শ্মশানবন্ধু। তুলসী পুরোহিত সেখানেই বুক চেপে ধরে শুয়ে পড়েন এবং তার হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি বন্ধ হয়ে যায়।

আমি ভাবছিলাম, আফিং-এর নেশা কতটা প্রবল হলে একজন মা তার নিজের মৃতা মেয়েকে নিয়ে এমন বীভৎস হ্যালুসিনেসন দেখতে পারে। কৈশোরের উগ্রতায় সেদিন আমি চিৎকার করে বলে উঠেছিলাম—চুপ করো, চুপ করো মেমদিদা। কীসব আলতু-ফালতু বকছ? এরকম হতে পারে নাকি?

মেমদিদা শান্ত গলায় বলেছিল—আমিও তো তাই ভাবতাম রে গোপাল। হতে পারে না। কিন্তু সেই যে হারামজাদা চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সেই যে আধপাগলা বুড়ো, আমার জামাই, সেই আমাকে একদিন তার ল্যাবরেটরির কোণে রাখা পাথরকুচির গাছ দেখিয়ে বলেছিল, দেখুন মা, দেখুন—কেমন পাতার কিনারা থেকে কচি-কচি শেকড় নামছে। ছোট ছোট মুকুল বাইরে মাথা বাড়াচ্ছে। পাথরকুচির ফল নেই, ফুল নেই। তবু জন্ম নিচ্ছে ঠিক মা-গাছটার মতনই কত চারাগাছ। চন্দ্রনাথ বলেছিল, একশো...ঠিক একশোবছর লাগবে মানুষের গুটি বড় হতে।

আমি তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা-জানলাগুলো হাট করে খুলে দিলাম। বাইরের আলো-হাওয়া ঘরে ঢুকতেই মনটা আবার বর্তমানকালে ফিরে এল। মনে হল, এই ভালো। ভালো এই ভিড়, রাস্তায় আলোর ত্রিশূল, অটোরিকশাওলাদের খিস্তি। এইসবের মধ্যে অন্তত মেমদিদার সেই বিকারগ্রস্ত কল্পনাগুলো লুকিয়ে থাকতে পারবে না। আলো এলে পাপ দূরে চলে যায়।


তিন


যখন মালিকপাড়ার বাড়িতে তালা লাগিয়ে বেরোলাম, তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে ন'টা। কলকাতা থেকে মাত্র পঁচিশমিনিটের দূরত্বে দাঁড়িয়ে-থাকা একটা শহরের কাছে এটা এমন কোনো রাতই নয়—তা হোক না সেটা জন্মাষ্টমীর বাদুলে রাত। তবু রাস্তায় এত কম লোকজন থাকার তো কথা নয়। মনে হচ্ছিল কারফিউ জারি হয়েছে কোথাও। 

যারা আছে তাদের মধ্যে একদলের চেহারা ভয়-জাগানো আর এক দলের ভয়-পাওয়া হাবভাব। প্রথম দলটাই সংখ্যায় ভারী।

রোগা খেঁকুরে পুরুষমানুষের ছোট ছোট দল রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দৈবাৎ কোনো মেয়ে—তা সে যে বয়সেরই মেয়ে হোক—চোখে পড়ে গেলে তারা হামলে পড়ছিল সেই মেয়ের গায়ে। নির্দ্বিধায় বুকে হাত দিচ্ছিল। সঙ্গে সিটি, খিস্তি, বিছানায় যাবার ডাক। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে দেখা বুনো কুকুরের দলের ছবি। হরিণীদের কথাও মনে পড়ছিল, বুনো কুকুরেরা যাদের জ্যান্ত ছিঁড়ে খায়।

শুধু এক্ষেত্রে ওদের খিদেটা পেটের খিদে নয়, তলপেটের। এত যৌন-উপবাসী মানুষ একসঙ্গে আমি কখনো দেখিনি।

ভয়-পাওয়া মানুষদের মধ্যে একজন আমার পাশেপাশেই হাঁটছিলেন। মাঝবয়সি মানুষটির চেহারা নিরীহ, কেরানি ধরনের। দেখেই বুঝতে পারছিলাম, উনি জোরে পা চালাবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পেরে উঠছেন না। সেটা বোধহয় কোনো শারীরীক অসুস্থতার কারণেই হবে। সমস্ত তাড়া ফুটে উঠছিল ওনার ভয়-পাওয়া চোখের তারায়। আপনমনেই তিনি বলে উঠলেন, আজ যে কী হবে ভগবানই জানেন।

আমি বললাম, কিসের কী হবে?

অন্যদিন একটা না একটা রিকশা পেয়ে যাই। আজ স্ট্যান্ড খালি। রিকশা পেলাম না। মামনকে নিয়ে ফিরব কেমন করে?

প্রশ্ন করলাম, মামন কে? আপনার মেয়ে?

হুঁ। টিউশনে পড়তে গেছে। এতবার বলি, সন্ধেবেলার টিউশনটা ছাড়! ছাড়! তা শোনেই না। সপ্তাহে এই দুটোদিন আমার যে কী টেনশনে কাটে তা কী বলব।

কেন বলুন তো? কিসের ভয়?

ভদ্রলোক চলা থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, বাইরের লোক?

আমি ঘাড় নেড়ে বোঝালাম, হ্যাঁ। 

রাত ন'টার পর বোষ্টমডাঙার রাস্তাগুলো হয়ে ওঠে কিলিং-ফিল্ড। বধ্যভূমি। বুঝলেন? মেয়েদের বধ্যভূমি। প্রতিদিন দুটো-তিনটে করে রেপ হয় এখানে। আমার মেয়ের বয়স পনেরো। এবার বুঝলেন, কিসের টেনশন?

ভদ্রলোক তারপর আমাকে জিগ্যেস করলেন, আপনি কোনদিকে যাবেন?

আমি?...থতমত খেলাম। 

কেমন করে বলি, যাবার কথা ছিল স্টেশনে। কিন্তু এইমাত্র আমার মাথায় একটা অদ্ভুত ঝোঁক চেপেছে। আমি কয়েকমুহূর্ত আগেই ঠিক করেছি, স্টেশন নয়। আমি শ্মশানের দিকে যাব। সেসব কথা না বলে ওনাকে বললাম, কোথাও যাব না। রাস্তায় হাঁটব। ওই দেখুন, একটা রিকশা আসছে। আপনি উঠে পড়ুন।

ভদ্রলোককে নিয়ে রিকশাটা চলে যাওয়ার পরে আমি অলিগলির মধ্যে দিয়ে পা চালালাম বিশাইচণ্ডী শ্মশানের দিকে। একবার ঘড়ির দিকে তাকালাম। দশটা। একটা কানাগলির মধ্যে থেকে মেয়েলি গলার আর্তনাদ আর তার সঙ্গে বেশ কয়েকটা পুরুষকণ্ঠের উল্লাস ভেসে এল। চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম, দুটো রোগা নির্লোম ফরসা পা দাপাতে-দাপাতে গভীরতর অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। কুকুরে শিকার টেনে নিয়ে যাচ্ছে। 

একটু আগে শোনা আরেকটা পুরুষকণ্ঠ হাহাকার করে উঠল—মামন মামন! ওগো, কে কোথায় আছ, আমার মেয়েকে বাঁচাও। 

অন্যদিন হলে কী করতাম বলতে পারছি না। কিন্তু আজ আমি চলা থামালাম না। আজ কুট্টিপিসির মৃত্যুর একশোবছর পূর্ণ হচ্ছে। চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন না, মানুষের বীজ ফুটতে একশোবছর লাগে? আজ আমার মনে হচ্ছে যদি এই ধর্ষণের রাজত্ব সত্যি হয় তাহলে মেমদিদার কথাও সত্যি। চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কথা সত্যি। কুট্টিপিসির শরীরে যে যোনি ছিল না সত্যি সেই কথাও। 

ওই তো, ওই তো শ্মশান। আমি অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে পোড়াকাঠ আর ভাঙা কলসির টুকরোয় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে দৌড়ে চললাম শ্মশানের লাগোয়া খালটার দিকে। ওই খালের পাড়ে নরম জমিতেই নাকি ডুবে গিয়েছিল কমা-চিহ্নের মতন রক্তমাংসের গুটিগুলো। একশোবছর...ঠিক একশোবছর আগে।

শ্মশানে আর কোনো মৃতদেহ ছিল না। ডোমের ঘরের উঠোনে একটা মাত্র কম পাওয়ারের বালব জ্বলছিল। তার ঘোলাটে আলোয় দেখলাম একটা দুটো-তিনটে মেয়ে—তিনটে উলঙ্গ মেয়ে, পূর্ণ যুবতী, তাদের চিকন স্তনে বালবের হলুদ আলো পিছলিয়ে যাচ্ছিল, সরু কোমর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল বৃষ্টির জলের ফোঁটা—আমার পাশ কাটিয়ে মেয়েগুলো শহরের দিকে রওনা দিল। 

আরও তিনটে মেয়ে ততক্ষণে কাদার ভেতর থেকে শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে উঠে আসছিল। আগের তিনটে মেয়ে শ্মশানের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। বুঝতে পারলাম, ওরা অপেক্ষা করছে বাকি তিন বোনের জন্যে। আমি দেখলাম, ওদের ছজনেরই মুখগুলো হুবহু এক— যেমন একরকম দেখতে প্রত্যেকটা পাথরকুঁচির গাছ। ওদের ছ'জনেরই চোখের পাতা স্বপ্নে ভারী আর ছ'জনেরই বাঁ-গালে আঁচিল।

ওদের ছ'জনকেই ওদের মায়ের মতন দেখতে। কুট্টিপিসির মতন দেখতে। সন্দেহ নেই ওরাই কুট্টিপিসির শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা সেই কমার মতন ভ্রূণ, একশোবছর ধরে মাটির রস খেয়ে যারা নারী হয়েছে। 

হঠাৎ শ্মশানের গেটের কাছ থেকে উল্লাসধ্বনি ভেসে এল। 'মার দিয়া শালা কেল্লা। এ শালা কি জিনিস পাঠিয়েছে রে ভগবান। আব্বে রশিদ, ভোকু, ছিনে—কোথায় গেলি বে? লুটে লে ইয়ার, লুটে লে'। 

আরো দশমিনিট বাদে একপাল হতবাক ধর্ষকের মধ্যে দিয়ে মাথা উঁচু করে হেঁটে শহরের দিকে চলে গেল ছ'জন উলঙ্গ যুবতী। দেখলাম তাদের উরুসন্ধিতে মার্বেল পাথরের মতন কঠিন নিভাঁজ ত্রিভুজ। বুঝলাম, ওরা আপাতত এই শহরের ধর্ষণযোগ্যা নারীদের মধ্যে মিশে যাবে। তারপর একদিন সঙ্গম ছাড়াই ওদেরও শরীর ভেদ করে ভ্রূণ জন্ম নেবে—রাশি রাশি কণ্যাভ্রূণ। একশো-পাঁচশো হাজার বছর পরে সারা পৃথিবী ছেয়ে যাবে যোনিহীন নারীতে।

তখন আর ধর্ষণ থাকবে না।

পুরুষও না।


Comments