বাচ্চুমামার বাড়ি
সৈকত মুখোপাধ্যায়
ভদ্রেশ্বরে ওলাবিবিতলায় একটা নির্জন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এই পুরোনো একতলা বাড়িটা বিশাখার বাচ্চুমামার বাড়ি। সন্ধে সাড়ে পাঁচটার সময় বাড়িটার বন্ধ সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিশাখা দুবার জোরে জোরে শ্বাস টানল। সে পরিষ্কার বুঝতে পারল, বাড়িটা পচে যাচ্ছে। নাহলে দরজা-জানলার ফাঁকফোকর থেকে ছাতাধরা পাঁউরুটির মতন ঝাঁঝালো গন্ধ বেরিয়ে আসবে কেন?
শেষবার যখন সে এই বাড়িতে এসেছিল তখন তার ক্লাস টুয়েলভ। তখন তার বয়স ছিল আঠেরো, আজ পঁয়ত্রিশ। সতেরো বছর বাদে বিশাখা এই বাড়িতে পা রেখেছে, অন্য কিছু নয়, কোনো এক অলৌকিকের সন্ধানে। সে যা চায় লৌকিক-চিকিৎসায় তার ব্যবস্থা নেই।
বিশাখা এখনো বেশি দূরে ট্র্যাভেল করতে পারে না। বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু তার শরীর খুব দুর্বল। তাছাড়া ডাক্তার মিশ্র বলে দিয়েছেন হাসপাতালের কাছাকাছি থাকতে আর শরীরে বেশি ধুলোবালি না ঢোকাতে। তাই কামাখ্যা, কনখল কিম্বা কুম্ভমেলায় তার পক্ষে এখনই যাওয়া সম্ভব নয় যদিও ওসব জায়গাতে আরো সহজে অলৌকিকের সন্ধান পাওয়া যায় বলেই বিশাখার বিশ্বাস।
সতেরো বছর আগে বিশাখা যখন প্রথম এই বাড়িতে এসেছিল, তখনই তার মনে এই বিশ্বাসের বীজ উড়ে এসে পড়েছিল যে, এখানেও আশ্চর্য কিছু ঘটে যাওয়া সম্ভব। বাচ্চুমামাই তেমন কিছু ঘটাতে পারে। সেইজন্যই বিশাখা একবার শেষ চেষ্টা হিসেবে আজ ভদ্রেশ্বরে এসেছিল।
বিশাখা বাচ্চুমামাকে জানায়নি যে, সে আসছে। জানাবে কেমন করে? বাচ্চুমামার ফোন-নম্বরই তো সে জানে না। সত্যিকথা বলতে কি, আজ এসে যদি শুনত বাচ্চুমামা মারা গেছে, কিম্বা দেখত এই বাড়িটার জায়গায় একটা ফ্ল্যাটবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাহলেও বিশাখা অবাক হত না। সতেরো বছরে কত কী ঘটে যায়। তবু বিশাখা মাত্র দুবার কড়া নাড়তেই ঘড়াং করে সদরের খিলটা খুলে গেল। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে বিশাখার বুকটা কেঁপে উঠল।
হ্যাঁ, বাচ্চুমামাই দরজা খুলেছে। সেইরকমই বেঁটে, মাকুন্দ, ঢুলুঢুলু চোখ— সতেরো বছর আগে যেমন দেখেছিল।
বাচ্চুমামার সঙ্গে বিশাখার মা কিম্বা মামা-মাসিদের চেহারার কোনো মিল নেই। তার অরিজিনাল মামাবাড়ির সকলেরই গড়নপেটন বেশ লম্বা-চওড়া। বিশাখাও মামাবাড়ির ধাত পেয়েছে। কিন্তু বাচ্চুমামা তো আর মায়ের নিজের ভাই নয়। কাজিন-টাজিনও নয়। নেহাত বরিশালের পাড়াতুতো সম্পর্ক।
বিশাখাকে দেখে বাচ্চুমামার কোনো বিকার ঘটল না। যেন বিশাখা রোজই পাঁচটা সতেরোর ব্যান্ডেল লোকাল ধরে কোন্নগর থেকে ওলাবিবিতলার এই বাড়িতে যাতায়াত করে। নির্বিকার গলায় ডাকল, কে বিনি? আয়! ভেতরে আয়!
বিশাখা খুব সাবধানে শ্যাওলা বাঁচিয়ে সরু উঠোনটা পার হল। বাচ্চুমামা যে ঘরটায় তাকে বসাল সেটার দেয়ালভরতি নোনা, বিমের ফাঁক দিয়ে টালির ছাদ ছাগলের পেটের মতন ঝুলে পড়েছে। জানলার দুটো শিক মরচে লেগে খসে পড়েছে। ফাঁকা জায়গাটা ভরাট করা হয়েছে আড়াআড়িভাবে বাঁধা পাড়ের দড়ি দিয়ে। বিনি মানে বিশাখা চিনতে পারল, এই ঘরটাতেই সেবার মা আর সোনাদিদা দুপুরবেলায় শুয়েছিল।
সতেরো বছর আগে বাড়িটার অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। সেই প্রথম মা তাকে এই বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে এসেছিল। তার কয়েক মাস আগেই বিশাখার বাবা মারা গেছেন। বিধবা হওয়ার পর ওর মায়ের হাতে সময় বোধহয় একটু বাড়তি হয়ে যাচ্ছিল, তাই প্রায়ই এরকম ভুলে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে হানা দিতে শুরু করেছিল। বিশাখা অনেক সময় শুধু মাকে একা ছাড়তে ভয় পেত বলেই মায়ের সঙ্গে সেসব বাড়িতে যেত।
তাছাড়া আরো একটা গোপন কারণ ছিল। ও তখনই বুঝে গিয়েছিল পড়াশোনাটা তার দ্বারা আর বেশিদিন চালানো সম্ভব নয়। তার মাথা মোটা। কাজেই বিয়েটা চটপট হয়ে গেলেই ভালো। আর কে না জানে, অভাবনীয় সব বিয়ের সম্বন্ধ আত্মীয়দের বাড়িতেই লুকিয়ে থাকে? কাজেই বিশাখা মায়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনোদিন এন্টালির মনুদিদার বাড়ি, কোনোদিন বেলঘরিয়ার জুলিকাকিমার বাড়ি, আবার কোনোদিন বা নৈহাটির সদামামার বাড়ি চলে যেত।
এইভাবেই একদিন মা বলল, চল, ভদ্রেশ্বরে সোনাপিসিমার কাছ থেকে ঘুরে আসি। বুড়ি কবে থাকে কবে চলে যায় ঠিক নেই। দেখা না হলে একটা আফশোস থেকে যাবে।
তো সেই যাওয়া।
বিশাখা শুনেছিল সোনাপিসিমার ছেলেটা জিনিয়াস, কিন্তু পাগল। খড়গপুর আই আই টি থেকে পড়া শেষ না করে পালিয়ে এসেছে। বাড়িতে এটা ওটা নিয়ে রিসার্চ করে। সেসব করে যে কি ঘোড়ারডিম হয় তা কারুর মাথায় ঢোকে না।
সেদিন দুপুরে খাওয়ার সময় একবার বাচ্চুমামাকে দেখেছিল বিশাখা। অমন নির্লোম নির্জীব বেটাছেলেকে দেখে তার কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠেছিল। ছেলেটা প্রায় কোনো কথা না বলেই খাওয়া সেরে উঠে গিয়েছিল। উঠোনের অন্যপ্রান্তে একটা ছোট ঘর ছিল, সেটাই নাকি তার ল্যাবরেটরি। সেই ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিয়েছিল।
খাওয়া-দাওয়ার পর মা আর সোনাদিদা বাইরের ঘরের চৌকির ওপর গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। বিশাখার কোনোকালেই দুপুরে ঘুমোনোর অভ্যেস ছিল না। সে অনেকক্ষণ ধরে একটা বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা নাড়াচাড়া করে বোর হয়ে বাড়িটা একটু ঘুরে দেখে আসতে বেরোল।
হয়তো উচিত হয়নি, কিন্তু সেদিন সে বাচ্চুমামার ল্যাবরেটরি ঘরটাতেই প্রথম উঁকি মেরেছিল। বাচ্চুমামা তখন খালিগায়ে একটা টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছিল। মুখ তুলে বিশাখাকে দেখতে পেয়ে, ইঙ্গিতে ভেতরে আসতে বলল।
বাচ্চুমামার লাচ্চা পরোটার লেচির মতন তেলতেলে আর থলথলে বডি। বিশাখা একটু ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় বাচ্চুমামা বিনা বাক্যব্যয়ে তার প্রতিভা দেখাতে শুরু করেছিল। বাচ্চুমামা কথাটা কমই বলত।
একটা ঢাকা দেওয়া তাকের ভেতর থেকে একে একে তার তৈরি করা জিনিসগুলো সেদিন বার করে এনেছিল বাচ্চুমামা। প্রথমে দেখিয়েছিল একটা গোল ক্যাকটাস। এরকম ক্যাকটাস বিশাখা অনেক দেখেছে। যেটা দ্যাখেনি সেটা হল ক্যাকটাস-টার কেটে ফেলা মাথার ওপরে গজিয়ে ওঠা একটা সোনায় সাদায় মেশানো গোলাপ। অপূর্ব তার রং! যেন বরফের প্রান্তরে ভোরের আলো এসে পড়েছে। অপূর্ব তার গন্ধ। বিশাখা সেদিন সেই গোলাপের রূপে এমনই মোহিত হয়ে গিয়েছিল যে, খেয়ালই করেনি কখন বাচ্চুমামা টেবিলের ওদিক থেকে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
পেছন থেকেই বাচ্চুমামা সেই দুপুরে বিশাখার সামনে বাড়িয়ে ধরেছিল পরের এগজিবিট—একটা লতা। লতা বললে তার কিছুই বোঝানো যায় না। আকার আকৃতি অনেকটা লাউডগার মতন, পাতাগুলোও সেইরকমই। কিন্তু পুরো লতাটাই যেন চুনিপাথর দিয়ে গড়া। এমন স্বচ্ছ, লাল আর উজ্জ্বল কোনো উদ্ভিদ তার আগে অবধি দ্যাখেনি বিশাখা। পাতার ভেতরে শিরা-উপশিরায় রক্তরসের চলাচল সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল।
হঠাৎ বিশাখার বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেল। সে অবাক হয়ে দেখল বাচ্চুমামার ডান হাতটা তার কাঁধের ওপর দিয়ে ঢুকে এসেছে ফ্রকের মধ্যে। তার ডানদিকের স্তনটা মুঠো করে ধরেছে বাচ্চুমামা আর স্কার্টের ওপর দিয়েই তার নিতম্বের ওপর চেপে বসেছে বাচ্চুমামার কঠিন পুরুষাঙ্গ। বিশাখা চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়েই চড় তুলেছিল বাচ্চুমামার গালে সপাটে কষাবার জন্যে, কিন্তু বাচ্চুমামার অন্য হাতটার দিকে তাকিয়ে তার উঁচিয়ে ধরা হাতটা আপনা থেকেই নেতিয়ে পড়ল। সত্যি কথা বলতে কী আজ এতদিন পরেও সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়লে বিশাখার মনে হয় সে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
বাচ্চুমামার অন্য হাতের মুঠোয় যত্ন করে ধরা ছিল একটা মুমূর্ষু খরগোশ। খরগোশটার টুকটুকে লাল চোখের ভেতর থেকেই চুনি-লতাটা গজিয়ে উঠেছিল। যেন ওটা খরগোশ নয়, একটা জ্যান্ত টব, যেখান থেকে রস শুষছিল সেই লতাটা।
একটা চিৎকার করে ল্যাবরেটরি থেকে সেদিন ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল বিশাখা। সোনাদিদা তখনো ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু মা নিশ্চয় তার সেই চিৎকার শুনেছিল। তার মুখ-চোখ দেখে কী হয়েছে তা কিছুটা আন্দাজও করেছিল নিশ্চয়, যদিও পুরোটা আন্দাজ করা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। যাই হোক, তারপর মারা যাওয়ার আগে অবধি মা তাকে আর কখনো সোনাদিদার বাড়ি যাওয়ার কথা বলেনি।
তবুও আজ নিজে থেকেই বিশাখা দ্বিতীয়বার এ বাড়িতে পা রাখল। পায়ের তলায় যখন আর মাটি পাচ্ছিল না তখন তার মনে পড়ে গিয়েছিল ওই ক্যাকটাস আর গোলাপের কিম্বা খরগোশ আর লাউডগার জোড়কলমের কথা। তাকে বাঁচতে হবে তো।
আজকের বাচ্চুমামার সঙ্গে সেই সতেরোবছর আগের বাচ্চুমামার অনেক অমিল দেখতে পাচ্ছিল বিশাখা। কী যেন এক ভয়ঙ্কর ফুর্তিতে আজ অস্থির হয়ে উঠেছিল লোকটা। ওর পোশাকটাও আজ হাস্যকর রকমের গর্জাস। একটা লাল সবুজ চেক কাটা বারমুডা আর লাল টি-শার্ট। মাথায় আবার একটা নীল টেনিস-ক্যাপ ঘুরিয়ে পরেছে। হাতের মুঠোয় একটা চাইনিজ টর্চ মুঠো করে ধরে রেখেছিল। থেকে থেকে সেটাকে জ্বালাচ্ছিল আর নেভাচ্ছিল। চৌকির ওপরে বসিয়ে রাখা একটা অ্যান্টিক ট্র্যানজিস্টর সমানে ক্যানকেনে হিন্দি গান উগরে দিচ্ছিল আর তার সঙ্গে তাল রেখে বাচ্চুমামা কখনো তুড়ি দিচ্ছিল, কখনো শিস দিচ্ছিল, কখনো ঘাড় নাড়াচ্ছিল। একটা বিয়াল্লিশ বছরের লোকের কি এরকম আচরণ স্বাভাবিক? বিশাখা ভেবে পাচ্ছিল না।
সেই কি এই আনন্দের উৎস? তাকে দেখেই কি...?
কিন্তু না। জামাকাপড়গুলো তো সে আসার আগেই বাচ্চুমামা গায়ে গলিয়েছে। রেডিয়ো কিম্বা টর্চটাও নিশ্চয় সে আসবে বলে কিনে আনেনি।
এই নরকের মতন ঘরে, এই দমবন্ধ করা নির্জনতায়, এত আনন্দ মানায়? বিশাখা বাচ্চুমামার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারছিল না বলেই মেঝের দিকে তাকাল। কিন্তু সেখানেও একটা আধমরা টিকটিকির ছানাকে অনেকগুলো ডেয়োপিপড়ে মিলে টানতে টানতে একটা ফাটলের দিকে নিয়ে চলেছিল। বিশাখা কোনদিকে তাকাবে বুঝতে না পেরে নিজের পায়ের পাতার দিকে চেয়ে বসে রইল।
একটু বাদে হঠাৎই রেডিয়োটা বন্ধ করে দিয়ে বাচ্চুমামা বলল, চল বিনি। ল্যাবরেটরি ঘরে চল। ওখানে বসেই তোর প্রবলেমটা শুনি।
একটা অন্ধকার বারান্দা পেরিয়ে বাইরের ঘর থেকে ল্যাবরেটরির দিকে যেতে-যেতে বিশাখা অবাক হয়ে দেখছিল, বারান্দার একদিকে একটা লোহার তারে সার সার খাঁচা ঝুলছে। পাখির খাঁচা। নানা সাইজের, নানা শেপের খাঁচা। বাচ্চুমামা সেই টর্চটাকে জ্বালাতে-জ্বালাতে, নেভাতে-নেভাতে, একটু এগিয়ে গিয়েছিল। বিশাখা সাহস করে একটা খাঁচার কাছে মুখটা নিয়ে যেতেই বিশ্রী গন্ধে তার ওয়াক এসে গেল। সে দেখতে পেল খাঁচার ভেতরে একরাশ পালক ছড়িয়ে পড়ে আছে।
পাখিটা মরে গেছে, তারই গন্ধ।
বিশাখা তাড়াতাড়ি বাচ্চুমামার নাগাল ধরবার জন্যে পা চালাল। হাঁটতে হাঁটতেই সে দেখল, সবক'টা খাঁচার ভেতরেই ঝরা পালক, মরা পাখি। শুধু তাই নয়। মাথার ওপরে যদি খাঁচা থাকে, তাহলে পায়ের কাছে রয়েছে ফুলের টব। প্রত্যেকটা টবে একটা করে শুকিয়ে চিমড়ে হয়ে যাওয়া ফুলগাছ।
বাচ্চুমামা! বিশাখা ডাকল।
বাচ্চুমামা হাঁটা থামিয়ে পেছন ফিরে তাকাল।
বল।
এই পাখিগুলো...আর ওই গাছগুলো। মরল কেমন করে?
বলছি। চল। আগে তুই তোর কথা বল, তারপর আমি আমার কথা বলব। বাচ্চুমামা অবিকল কাচভাঙার শব্দের মতন আওয়াজ করে হাসল।
একটা হাতলভাঙা চেয়ারের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে বাচ্চুমামা বলল, হ্যাঁ, এবারে বল। পৃথিবীতে এই একটা জায়গাই সেফ, বুঝলি বিনি? তুই নির্ভয়ে বলে যা। কেউ শুনতে আসবে না।
বিশাখা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, মানে? ফাঁকা বাড়িতে আবার কে কী শুনবে?
কি যে বলিস না! তুই আর বড় হলি না। আরে, শুয়োরের বাচ্চায় দুনিয়াটা ভর্তি। সবাই সারাক্ষণ টিকিটিকির মতন আমার ওপরে, শুধু আমার ওপরে নজর রেখে চলেছে।
বাচ্চুমামা ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে একবার পুরো ঘরটায় পায়চারি করে এল। তারপর আবার দুহাতের মধ্যে হাঁটুদুটো জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসে পড়ল।
বিশাখা সালোয়ার কামিজ পরেছিল। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর হঠাৎই মাথার ওপর দিয়ে গলিয়ে কামিজটা খুলে ফেলল। বাচ্চুমামার দিকে পেছন ফিরে বলল, ব্রায়ের স্ট্র্যাপগুলো খুলে দাও তো।
বাচ্চুমামার কী কামবোধ ফুরিয়ে গিয়েছে? নির্বিকার গলায় বলল, কেন?
দাও না। মুখে বলার চেয়ে দেখলেই তোমার বুঝতে সুবিধে হবে বেশি।
বাচ্চুমামা বলল, নীচু হ'। তারপর চেয়ারে বসেই ব্রা-এর হুকগুলো খুলে দিল। বিশাখা বাচ্চুমামার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বাচ্চুমামা তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বিশাখার গলার কাছাকাছি মুখ এনে ঝুঁকে পড়ে তার বুকটা দেখতে শুরু করল। বিশাখার বুকে বাচ্চুমামার নিশ্বাস এসে লাগছিল।
সতেরো-বছর আগে এই লোকটাই তার ডান স্তনটা মুঠো করে ধরেছিল। সেই স্তনটা আর নেই। তার জায়গায় একটা বিশ্রী ক্ষত। সেটাই মন দিয়ে আঙুল বুলিয়ে পরীক্ষা করে দেখছিল বাচ্চুমামা। বিশাখার বাঁ স্তনটা এখনও নিটোল এবং সুন্দর, কিন্তু সেটার ব্যাপারে বাচ্চুমামার কোনও আগ্রহ দেখা গেল না।
বিশাখা মনে মনে বলল, মালটা ধ্বজে গেছে।
বাচ্চুমামা আবার তার সেই ভাঙা চেয়ারে বসে পড়েছিল। বসে বসে আঙুল মটকাচ্ছিল। বিশাখা উদোম গায়েই ওর মুখোমুখি একটা টুলের ওপর বসল। বলা যায় না, যদি আবার কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হয়।
বাচ্চুমামা একটু বাদে বলল, বাইরে থেকে বোঝা যায় না তো!
বিশাখা শুকনো হেসে বলল, ও কিছু না। ডানদিকের কাপে প্যাডিং আছে। কিনতে পাওয়া যায়।
তো, সেইভাবেই চালা না। না কি বিয়েটিয়ে করার ইচ্ছে আছে?
না বিয়ে নয়। আমার প্রফেশনটা মার খাচ্ছে। কাস্টমাররা এই বুক দেখলে ঘরের খিল খুলে প্যান্টের চেন আটকাতে আটকাতে দৌড়োয়।
এইবারে এমনকি নির্জীব বাচ্চুমামারও মুখটা একটু ফ্যাকাশে দেখালো। আমতা আমতা করে বলল, তুই কি...তুই কি...?
বিশাখা বাচ্চুমামার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ। লাইনে নেমে গেছি। বছর দশেক হয়ে গেল। ভালোই চলছিল, কিন্তু তার মধ্যে এই ব্রেস্ট ক্যানসার। আমি শেষ হয়ে যাবো বাচ্চুমামা। না খেতে পেয়ে মরে যাব। তুমি আমাকে ওটা ফিরিয়ে দাও।
বাচ্চুমামা আমতা আমতা করে বলল, কী সব সিলিকন ট্রিটমেন্ট-ফিটমেন্ট আছে না? চেষ্টা করে দেখেছিস?
না। প্রথম কথা বড্ড খরচ অত পয়সা নেই আমার। অপারেশন করাতেই ফতুর হয়ে গেছি। আর দ্বিতীয় কথা, বলতে খারাপ লাগছে, আমাদের প্রফেশনে বুকের ওপর যেরকম ধামসা-ধামসি চলে, অরিজিনাল মেয়েমানুষের বুক ছাড়া সে অত্যাচার সইতে পারবে না।
তারপরেই বিশাখা হঠাৎ খেপে উঠল। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, কেন? তুমি পারো তো। তাহলে ন্যাকামো করছ কেন? আমার জন্যে এইটুকু পারবে না?
কেমন করে বুঝলি, পারি?
বিশাখা উত্তর না দিয়ে ঘরের কোনায় রাখা খাঁচাটার দিকে তাকাল। বড়সড় খাঁচাটার মধ্যে একটা গিনিপিগ কপিপাতা চিবোচ্ছিল। তার পিঠের লোম ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে একটা মানুষের কান, একেবারে রক্তমাংসের কান। শুধু সাইজটা স্বাভাবিক কানের চেয়ে অনেক বড়। প্রায় একটা ন-নম্বর হাওয়াই চটির মতন।
বাচ্চুমামা মুচকি হেসে বলল, তোকে মাথামোটা ভাবতাম। ভুলই ভাবতাম দেখছি। হ্যাঁ, পারি। এতদিন চেষ্টার পরে ব্যাপারটা ধরে ফেলেছি। কিন্তু মুশকিলটা কী জানিস? ওই দ্যাখ, কানটা বেড়ে চলেছে। বেড়েই চলেছে। তবে কন্ট্রোল করার একটা রাস্তাও রিসেন্টলি বার করেছি অবশ্য।
তাহলে? তাহলে আর চিন্তা কিসের? বাচ্চুমামা, তুমি আমার ডানদিকেরটা ফিরিয়ে দাও। বিশাখা অবিকল বেশ্যার মতন রঙ্গ করে বলল—আমিও তোমাকে আবার দাঁড় করিয়ে দেব, দেখো। আমিও ম্যাজিক জানি।
বাচ্চুমামা চিন্তিত মুখে বলল, না, ওসব কিছু নয়। আমি ভাবছি, কন্ট্রোলটা ধরে রাখার জন্যে আমাকে তো ঠিক থাকতে হবে।
তুমি তো ঠিকই আছ। বিশাখা অবাক হয়ে বলল।
সে তো এখন। কিন্তু যদি কিছু গন্ডগোল হয়ে যায়?
কিচ্ছু হবে না বাচ্চুমামা। ভগবান আছেন।
বড্ড লোভে ফেলে দিলিরে বিনি। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আরেকবার বিশাখার বুকের এখানে ওখানে আঙুল দিয়ে টিপেটুপে দেখল বাচ্চুমামা। তারপর বলল, কখনো তো ভাবিনি গিনিপিগ বা খরগোশের বাইরে আর কোনো কিছুর ওপর পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পাব। যাগগে, যা কপালে আছে তাই হবে। তুই তাহলে কাল চলে আয়। মাসখানেক থাকার মতন জোগাড়যন্তর করে আসবি। আশাকরি তার মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
প্রথমে বাচ্চুমামা তার বাম দিকের স্তনটা থেকে কিছু সেল নিয়ে পেট্রি-ডিশে কালচার করতে দিয়েছিল। তারপর সেই টিস্যু নিয়ে ডানদিকে ইমপ্ল্যান্ট করেছিল। এসব শব্দ বাচ্চুমামার কাছেই শেখা।
পনেরোদিনের মাথায় বিশাখা বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জা পেল। তার আবার স্তনোগম হচ্ছিল—যদিও শুধু একদিকে। সেই দশ-এগারো বছরের ফিলিংসটা আবার ফিরে আসছিল তার মধ্যে।
বাচ্চুমামার ফুর্তি দেখে কে? রংচঙে জামাকাপড় পরছে। ভাঙা সাইকেল নিয়ে সারা বিকেল রাস্তায় চক্কর মারছে। এমনকী একদিন খাঁচা ভর্তি মুনিয়া পাখি কিনে নিয়ে চলে এল। পরেরদিন টবে লাল রঙ্গন। গাছে জল দিচ্ছে, পাখিকে খেতে দিচ্ছে। কে বলবে এই লোকটাই সতেরো বছর আগে অমন নির্জীব ছিল?
একমাসের মাথায়, সেদিন বোধহয় পূর্ণিমা, বিশাখা দেখল উঠোনের মাথায় একফালি আকাশের মধ্যে কোনোরকমে শরীরটাকে গলিয়ে দিয়েছে এত বড় একটা চাঁদ। আর সেই চাঁদের মরা-আলোর মধ্যে উঠোনের এক কোণে বসে আছে একটা ভূত।
না, ভূত নয়। বাচ্চুমামা। সাদা খাটো পাজামা আর গেঞ্জি গায়ে বাচ্চুমামা কেমন যেন জড়ভরতের মতন বসে আছে। ওর গা থেকে সব রং উধাও। বিশাখাকে দেখে বাচ্চুমামা ডাকল—কে, বিনি? এদিকে শোন।
বিশাখা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বাচ্চুমামার কাছে। লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, তোমাকেই খুঁজছিলাম। বাচ্চুমামা, দুটো একেবারে এক সাইজের হয়ে গেছে। এবার গ্রোথটা বন্ধ করে দাও।
বাচ্চুমামার কানে যেন কথাটা ঢুকলই না। বলল, বিনি, তুই ম্যানিক-ডিপ্রেশন কাকে বলে জানিস? কিম্বা বাইপোলার ডিজঅর্ডার? নাম শুনেছিস?
বিশাখা ঘাড় নাড়ল।
বাচ্চুমামা বলল, একটা অসুখেরই দুটো নাম। অসুখটা আমার আছে। কী হয় জানিস? এই ভীষণ ফুর্তিতে আছি। খাচ্ছিদাচ্ছি, নেচে বেড়াচ্ছি। নানারকমের এক্সপেরিমেন্ট করছি। এক মাস দু-মাস ভালোই কাটে। তারপরেই মাথার মধ্যে কী যে হয়ে যায়। অবসাদ, প্রচণ্ড অবসাদ আমাকে চেপে ধরে। কিচ্ছু ভালো লাগে না। কেবল মরে যেতে ইচ্ছে করে।
বিশাখা বলল, যাঃ! তাই আবার হয় নাকি?
প্রমাণ আছে। ওই পাখিগুলো। ওই গাছগুলো।
বিশাখা ঘাড় ঘুরিয়ে জ্যোৎস্নার গাঢ় ছায়ায় ঢাকা খাঁচা আর টবগুলোকে দেখল।
যখন ভালো থাকি তখন পাখি কিনি, গাছ কিনি। খুব ভালো লাগে জানিস? মনে হয় কী সুন্দর এই পৃথিবীটা। প্রত্যেকটা পাতা, প্রতিটা পালকের পেছনে প্রকৃতির কত হাজার কোটি বছরের যত্নের ছাপ রয়েছে। ওদের ভালোবাসি, আদর করি। আমাদের শরীরও আলাদা কিছু নয়। তাই শরীরকেও আদর করতে ইচ্ছে করে।
বাচ্চুমামা, কীসব আবোলতাবোল বকছ?
সত্যিরে। যাই হোক, যা বলছিলাম। তারপর একদিন হঠাৎ সবকিছু অনর্থক মনে হয়। তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। প্রাণপণে চেষ্টা করি আত্মহত্যাকে ঠেকিয়ে রাখতে। এদিকে বাড়ির উঠোনে আমার পাখি আর গাছগুলো খাবার না পেয়ে, জল না পেয়ে, মরে যায়।
বিনি, আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমি যাই।
বাচ্চুমামা হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে দড়াম করে বাইরের ঘরের দরজায় খিল লাগিয়ে দিল।
খিল লাগাল তো লাগাল। বাচ্চুমামার আর ঘর থেকে বেরোবার নাম নেই। বিশাখা প্রথমে কিছুদিন বাইরে বেরিয়ে দোকান থেকে পাখির জন্যে কাঙনদানা, গাছের জন্যে খোল আর নিজের আর বাচ্চুমামার জন্যে চালডাল কিনে আনছিল। গিনিপিগটাকে সে আলু কিম্বা কুমড়োর খোসা খেতে দিত।
তারপর পাড়ার গিন্নিরা অবাক হয়ে ওর বুকের দিকে চাইতে শুরু করল।
ওদের মধ্যেই একজন একদিন বেশ উঁচু গলাতেই বলল, একটু ছোটবড় আমাদেরও অনেকসময় হয়। তাই বলে এত? আর কী সাইজ মা! ঘেন্না লাগে দেখলে।
তারপর বিশাখার আর বেরোবার মতন অবস্থা রইল না। সে জানলার ফাঁক দিয়ে বাচ্চুমামার জন্যে ভাতের থালা গলিয়ে দিত আর কেঁদে বলত, বাচ্চুমামা, স্টপ করো, স্টপ করো। আমি আর পারছি না। আমার পিঠে ভীষণ যন্ত্রণা বাচ্চুমামা। ঠাকুরমার ঝুলির রাক্ষুসির মতন আমার ডানদিকের বুক হাঁটুর কাছে ঝুলে পড়েছে। বাচ্চুমামা, দরজা খুলে বেরোও। কিছু একটা করো।
আঠাশ দিনের মাথায় মুনিয়াপাখিগুলো মরল। রঙ্গনগাছটা তো তার অনেক আগেই মরেছিল। গিনিপিগটা ঠিক না খেতে পেয়ে মরেনি। ওর পিঠ থেকে গজিয়ে ওঠা সেই কানটা ওকে চুষে নিয়েছিল। শেষদিকে কানটা একটা কচুপাতার মতন বড় হয়ে গিয়েছিল। বিশাখা উঠোনে গর্ত করে ওটাকে পুঁতে ফেলেছিল।
পরের পূর্ণিমায় বিশাখা জানলার ফাঁক দিয়ে দেখল, মেঝে থেকে অনেকটা ওপরে বাচ্চুমামার পায়ের পাতা দুটো দুলছে।
এরপর বিশাখা নিজেও আর বেঁচে থাকার সাহস পায়নি।
Comments
Post a Comment