জলকষ্ট - ঈশ্বরের নষ্ট ভ্রূণ - সৈকত মুখোপাধ্যায়

জলকষ্ট

সৈকত মুখোপাধ্যায়


এমনিতে আঠেরো বছর বাদে বীরশিবপুরের শ্রীরথীন ব্যানার্জির বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আমার কোনো দরকার ছিল না। গেলাম যে, স্বীকার করি বা নাই করি, তার পেছনে একটাই কারণ ছিল—আমার প্রথম প্রেম।

প্রেম কিম্বা এক নারীর শরীর। দুটোর তফাত আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়। 

আঠেরো বছর আগে আমার জ্যাঠামশাইয়ের স্কুলের বন্ধু রথীনজেঠুর বাড়িতে দুটো রাত কাটিয়েছিলাম। আসলে বীরশিবপুর গ্রামের গায়েই অজয় নদ আর নদী পেরোলেই কেঁদুলির মেলা। তো, জ্যাঠামশাই যখন শুনলেন আমি মেলা দেখতে যাচ্ছি, তখন উনিই বললেন—দ্যাখ তিনু, তুই সুখী প্রকৃতির ছেলে। ওসব মেলার আখড়ায় খড়ের বিছানার ওপরে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোনো টুমোনো তোর পোষাবে না। তাছাড়া আমি গিয়ে দেখেছি, চারদিকে বড্ড গাঁজার গন্ধ। যাচ্ছিস যা, তবে রাতটা বীরশিবপুরে রথীনের বাড়িতে কাটাস। ওদের ওখান থেকে মেলা হাঁটাপথে তিরিশ মিনিট। অবশ্য নদীতে জল বাড়লে নৌকা ধরে পেরোতে হয়। তখন আরেকটু বেশি সময় লাগে। 

আমি জ্যাঠামশাইকে বললাম, ওরকম হুট করে অচেনা লোকের বাড়িতে গিয়ে ওঠা যায় না কি? 

জ্যাঠামশাই অবাক গলায় বললেন, অচেনা বলছিস কাকে? রথীন তোর অন্নপ্রাশনে আসেনি? তাহলে? তাছাড়া ও গরিব হলেও দিলদার লোক। তুই শুধু ওর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয়টা দিয়ে দ্যাখ না, কী করে।

সবদিক ভেবে আমি রাজি হয়ে গেলাম। সত্যিই আমি শীতকাতুরে। আর কেঁদুলির মেলার শীত যে দার্জিলিংকে হার মানায় সে কথা আমি অনেক বিশ্বাসযোগ্য লোকের মুখেই শুনেছি। তাছাড়া মদ গাঁজা খাই না, কিন্তু আবার পাগলের মতন লোকগান ভালোবাসি। সবদিক মেলানোর জন্যে আঠেরোবছর আগে এক শীতের দুপুরে আমি পানাগড় স্টেশনে নেমে, বাস ধরে বীরশিবপুরে পৌঁছে, 'প্যাটেল পাওয়ার ইন্ডাস্ট্রি'র ওয়েল্ডার শ্রীরথীন ব্যানার্জির দরজায় কড়া নেড়েছিলাম। 

দরজা খুলেছিল রথীনজ্যেঠুর মেয়ে পিয়ালি। তাকে দেখেই আমি প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।

তখন আমার তেইশ-বছর বয়স। সবে চাকরিতে ঢুকেছি। ওই বয়সে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট-টা খুব অস্বাভাবিক নয়। তার ওপরে পিয়ালির ছিল ভারি মমতামাখা দুটো চোখ আর চাবুক ফিগার। 

সুখের কথা, পিয়ালি নামে সেই উনিশ-বছরের মেয়েটাও সেদিনই আমার প্রেমে পড়ে গেল...তবে ঠিক প্রথম দর্শনে নয়। মোটামুটি সত্তর-আশিবার চোখাচোখি, দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত, তিনটে লোকগীতি আর খান চারেক পূর্ণেন্দু পত্রী শোনাবার পর। বলাই বাহুল্য, সেসব গান কবিতা সবকিছুই ছিল যাকে বলে আহ্বানে আকুল। পিয়ালি রেজিস্ট করতে পারেনি।

তো সেই প্রথম দুটো দিন আর তার পরের এক বছরে ওখানে কাটিয়ে আসা আরো অনেকগুলো দিনের স্মৃতি যে এখনো ভুলতে পারিনি সেটা বুঝতে পারলাম এবার পানাগড় গিয়ে। 

ইতিমধ্যে কিন্তু আমার বিয়ে-থা হয়ে গেছে। অনেকদিন ধরেই আমি যাকে বলে ঘোর সংসারী। মাঝের এই আঠেরো বছরে পিয়ালি নামের সেই রোগা ফর্সা মেয়েটার মুখ আঠেরোবারও মনে পড়েছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু মনের অদ্ভুত গতির কথা কে বলতে পারে? পানাগড়ে ব্র্যাঞ্চ-অফিস ইনস্পেকশনের কাজটুকু দুপুর দুপুর শেষ হয়ে যেতেই, মন বলল, চলো বীরশিবপুর! চলো, একবার দেখে আসবে পিয়ালিকে। নাহয় সন্ধের ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরেই বাড়ি ফিরবে। লোকাল ট্রেনে ঘটর-ঘটর করে পাঁচঘণ্টায় হাওড়া পৌঁছোনোর চেয়ে সেই জার্নিটা বেশি আরামদায়কও হবে, তাই না? 

এইসব উলটোপালটা বুঝিয়ে মন আমাকে পথে নামাল। কাউকে কিছু না বলে বর্ধমানগামী বাসে উঠে বসলাম। যদ্দুর মনে পড়ছে, আগের বার ওখানে পৌঁছতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লেগেছিল। এবারে সময় লাগল আরো দশ মিনিট কম, কারণ, ইতিমধ্যে রাস্তার অনেক উন্নতি হয়েছে। 

বীরশিবপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখলাম কিছুই প্রায় বদলায়নি। সেই মোরাম-রাস্তার দুপাশে কদম, বাবলা আর নিমের ছায়ার আড়ালে ক্যানালের জলের ঝিকিমিকি। এখানে ওখানে দু-চারটে নতুন একতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। পরিবর্তন বলতে ওইটুকুই। শেষ বিকেলের হলুদ রোদ গায়ে মেখে, পাখির ডাক শুনতে শুনতে পা চালালাম ছোট্ট গ্রামটার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ দোতলা বাড়িটার দিকে। ভুলিনি, কিছুই ভুলিনি। ব্যানার্জিবাড়ির রাস্তা দিব্যি মনে আছে। 

কিছুটা যাওয়ার পরে হঠাৎ আমার মনে এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম একটা বিপরীত চিন্তা খেলা করে গেল। মনে হল, ধুর, এ কি পাগলামি করছি? পিয়ালি কি এখনো আমার জন্যে বাপের বাড়িতে বসে আছে নাকি? কবেই নিশ্চয় বিয়ে-টিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। তাহলে আজ কার জন্যে ওখানে যাচ্ছি? 

অন্য একটা মন বলল, শোনো তিনু। নাহয় আজ তার শ্বশুরবাড়ির খোঁজটুকুই নিয়ে এলে। জেনে এলে সে সুখে আছে, ভালো আছে। সেটুকুই যদি জানতে পারো, তোমার ভালো লাগবে না? একদিন ভালোবেসেছিলে তো তাকে।

আরেকটা মন বলল, আঘাতও তো করেছিলাম। ছেড়েও তো এসেছিলাম তাকে খুব তুচ্ছ একটা কারণে। তাহলে?

প্রথম মন উত্তর দিল, মেয়েদের ক্ষমা করার ক্ষমতা তুমি জানো না, তাই সঙ্কোচ করছ। ওদের ওই ক্ষমাটুকু না পেলে সংসার অচল হয়ে যেত। তুমিও পাবে, চিন্তা কোরো না। আজ শুধু সুযোগ পেলে একবার তাকে বলে এসো—স্যরি। ওই শব্দটা বলার জন্যে আঠেরোবছর মোটেই কিছু বেশি সময় নয়।



আশ্চর্য ব্যাপার, পিয়ালিকে তার বাপের বাড়িতেই পেলাম। এবারেও পিয়ালিই দরজা খুলল, তবে আগের বারের মতন দুবার কড়া নাড়ার পরেই নয়। কড়া নাড়তে নাড়তে যখন হাতে ব্যথা হয়ে গেছে, ভাবছি ফিরে যাব কিনা, তখনই ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে ওদের সদর দরজাটা খুলে গেল। খিল খোলার কিম্বা ছিটকিনি নামানোর আওয়াজ পেলাম না। কেমন যেন মনে হল, বাইরে থেকেই একটা জোরালো হাওয়া ধাক্কা মেরে রংচটা কাঠের পাল্লাদুটোকে খুলে দিল। যাইহোক, দরজায় যে দাঁড়িয়েছিল তাকে চিনতে ভুল হবার কথা নয়। কারণ, বিগত আঠেরো বছরে তার শরীরে মুখে কোনো বদলই আসেনি। 

রোগা মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেকসময় এরকম হয়। 

পিয়ালি খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, এসো তিনুদা। ভেতরে এসো। হঠাৎ আজ এতদিন বাদে এমন হুট করে চলে এলে যে? 

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, এবার জ্যাঠামশাইয়ের ফোন নম্বরটা নিয়ে যাব। আসবার আগে জানিয়েই আসব।

স্বীকার করি, এই মন্তব্য একশোভাগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ, আমি ততক্ষণে দেখে নিয়েছি পিয়ালির সিঁথিতে সিঁদুর নেই। হাতেও নেই কোনো এয়োতির চিহ্ন। ও কি কুমারী নাকি বিধবা? নাকি ডিভোর্সি? যাই-ই হোক, ওকে আবার নতুন করে ভালোবাসা যায়। নতুন করেই ভালোবাসব ওকে। এখন থেকে আমাকে আপিসের কাজ নিয়ে মাসে একবার করে পানাগড় যখন আসতেই হচ্ছে, তখন কেন পুরোনো প্রেম কিম্বা পুরোনো ইন্টুমিন্টু আবার ঝালিয়ে নেব না? 

সেবার বড় তুচ্ছ কারণে মেয়েটাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম। কবুল করছি, ওরকম নবাবী আরো কয়েকটা মেয়ের সঙ্গেও করেছিলাম। একটা মেয়েকে তো প্রোপোজ করতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই সে গুড়ুম করে একটা ঢেকুর তুলল। আমিও ধুত্তোর বলে চলে এলাম। আর সেই মেয়েটার মুখদর্শনও করিনি কখনো।

তবে কথা হচ্ছে কি, ওসব লাক্সারি একজন তেইশ বছর বয়সের এলিজিবল ব্যাচেলরকেই মানায়। এখন একচল্লিশ বছরে পৌঁছিয়ে মেয়েদের মনে হয় বড়ই মহার্ঘ্য। একটু-আধটু ঢেকুর কিম্বা নিশ্বাসের দুর্গন্ধ এখন দিব্যি সহ্য করে নেব। 



দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে চারিদিকে তাকালাম। 

হিসেব করে দেখলে হয়তো আগের ফেজে সব মিলিয়ে মাত্র পনেরো ষোলোটা দিনরাত্রি এই বাড়িতে কাটিয়েছিলাম। কিন্তু অত তীব্র দিনরাত তো তার আগে বা পরে আর যাপন করিনি। তখন তো ভাবতাম, এই বাড়িটাই একদিন আমার শ্বশুরবাড়ি হবে। যা দেখতাম সবকিছুই তাই ভালোবেসে বুকের ভেতরে শুষে নিতাম। কিন্তু সেই স্মৃতির জলছবির সঙ্গে কিছুই প্রায় মিলছিল না।

সদরের পরেই ছিল ভিতরবাড়ির চৌকোনা উঠোন। সেই উঠোনের তিনদিকে ঘোরানো দালানের গায়ে ছ'টা ঘর আর চতুর্থদিকে কলতলা আর বাথরুম। ঘোরানো দালানে তেলসিঁদুরের মতন চকচকে লাল সিমেন্টের মেঝে ছিল। ঘরগুলোর দরজায় জ্যাঠাইমার নিজের হাতে পুরোনো শাড়ি কেটে বানানো পর্দা ছিল। উঠোনের তারে টিয়াপাখির খাঁচা ঝুলত। কলঘরের ছাদে একটা শুকনো শিমের লতা ছিল। হ্যাঁ, নদীর ধারে বাড়ি, তবু বীরশিবপুরে জলকষ্ট ছিল খুব। সেইজন্যেই শিমগাছটা শুকিয়ে গিয়েছিল। 

ঘরটর এখনো আছে কিন্তু অন্য অনেক কিছুই নেই। 

পিয়ালি আমার পেছনে সদর দরজাটা বন্ধ করে দিতেই পুরো দালান অন্ধকারে ঢেকে গেল। ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল, তাই উঠোনের ওপরের আকাশে আর আলো ছিল না। বাড়ির ভেতরেও আর কোথাও আলো জ্বলছিল না, শুধু পশ্চিমের একটা দরজা দিয়ে একটা হলুদ আলোর চৌখুপি এসে পড়েছিল সামনের দালানে। যেন একটা ছেঁড়া তাস ভুল করে কেউ প্যাকেটের বাইরে ফেলে রেখে গেছে।

সেই আলোতেই দেখতে পাচ্ছিলাম—একদার সেই লাল মেঝের দালান ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। উঠোনের অবস্থা আরো করুণ। জায়গায় জায়গায় তুলসী আর সন্ধ্যামনির ঘন ঝোপ মাথা চাড়া দিয়েছে। আমাদের চোখের সামনে দিয়েই একটা বেজি গদাইলশকরি চালে উঠোনের একদিক থেকে অন্যদিকে চলে গেল।

আমি বললাম, কী ব্যাপার বলো তো পিয়ালি? তখন জলের আকালে একটা শিমগাছও বাঁচত না। ছোলা ভেজানোর জলটুকু যাতে বাঁচানো যায় তার জন্যে টিয়াপাখিটাকে দিনের পর দিন শুকনো ধান খেতে দিতে। আর এখন এত স্বাস্থ্যবান সব ঝোপঝাড় গজাচ্ছে কেমন করে?

পিয়ালি বলল, ওমা! চিরকাল একইরকম কাটবে নাকি? তুমি চলে যাওয়ার পরেপরেই হাটতলায় ডিপ-টিউবওয়েল বসল তো। তখন থেকেই আমাদের ঘরে জলে ভাসাভাসি কাণ্ড। যদি আর ক'টা দিন আগে এমন জল আসত গো! 

পিয়ালির দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে আমার দীর্ঘনিশ্বাস মিশে গেল। ও ঠিকই বলেছে। তখন বীরশিবপুরে জলের সুখ থাকলে, সেই উপচে পড়া জলের সঙ্গে আমাদের জীবনটাই হয়তো অন্য খাতে বয়ে যেত।

আমার ভাবনা অবশ্য একটু পরেই অন্যদিকে মোড় নিল। সারা বাড়িতে এমন অলক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আঁকা কেন? জলের সঙ্গে এসবের তো কোনো সম্পর্ক নেই। আঠেরো বছর আগেও এনাদের অভাবের সংসার ছিল। তবু তার মধ্যেই পিয়ালি আর জ্যাঠাইমা মিলে সংসারটাকে কী অদ্ভুত সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতেন। তখন এই বাড়িতে পাড়ের সুতো দিয়ে বোনা কাঁথা ছিল, পুরোনো শাড়ি কেটে বানানো পর্দা ছিল। কত বই ছিল, গানের ক্যাসেট ছিল। অল্প কয়েকটা বাসন সোনার মতন ঝকঝক করত। অল্প কয়েকটা সস্তা কাঠের আসবাব মা-বেটির মোছামুছির চোটে আরশোলার পিঠের মতন চকচক করত। 

পেছন ফিরে দেখলাম, পিয়ালি অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমার মাথায় প্রসঙ্গত যে-প্রশ্নটা ঘুরছিল, সেটাই করে বসলাম।

জ্যাঠাইমা কোথায়?

পিয়ালি আঙুল তুলে আকাশের দিকে দ্যাখাল। ঠোঁটে মজা পাওয়ার মতন হাসি।

আমি জিগ্যেস করলাম, সেকি! কবে?

পিয়ালি বলল, হয়ে গেল পনেরো বছর।

জ্যাঠামশাই?

ওই ঘরে আছেন। আলো জ্বলা ঘরটার দিকে ইশারা করল পিয়ালি। তারপর বলল, বাবা অন্ধ হয়ে গেছে। একটা ওয়েল্ডিং রড চোখের সামনে ফেটে গিয়েছিল। সে-ও সাতবছর হয়ে গেল। তখন থেকেই আমি এখানে থাকি। নাহলে বাবাকে দেখবে কে?

তার মানে পিয়ালির বিয়ে হয়েছিল। বরকে ছেড়ে এসেছে? নাকি বরও মারা গেছে? যাই হোক, পরে জানা যাবে। আপাতত আনন্দের খবর এইটুকুই যে পিয়ালি এখানেই থাকে। অন্ধের চোখের সামনে একা। আর পিয়ালি আগের মতনই মোহময়ী। 

আমি হাতের অ্যাটাচিটা নামিয়ে রেখে জুতো খুলে পায়ে পায়ে জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে ঢুকলাম। না ঢুকলেই ভালো করতাম বোধহয়। সে যে কী কী নরকের মতন ঘর, কি যে বিকট গন্ধ, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। স্তূপীকৃত ছেঁড়া কাঁথা, নোংরা বালিশ আর তেলচিটে মশারির ওপরে হেলান দিয়ে বসে সাঁইসাঁই শব্দ করে যে কঙ্কালটা শ্বাস নিচ্ছিল তাকে দেখে আঠেরো-বছর আগের রথীন ব্যানার্জি বলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, কেমন আছেন, জ্যাঠামশাই?

কে?—সরপড়া ছলছলে চোখদুটো আমার দিকে ফিরিয়ে উনি প্রশ্ন করলেন। 

আমি তীর্থঙ্কর, জ্যাঠামশাই। তিনু। উত্তরপাড়ার বাসুদেব মুখার্জির ভাইপো। মনে পড়ছে। আগে আপনাদের বাড়িতে অনেকবার এসেছি। মনে পড়ছে? 

লিচুর শাঁসের মতন মণিহীন চোখদুটোয় হঠাৎ লিচুর খোসার রং ধরল। ফিসফিস করে বললেন, মনে পড়বে না? তুমিই তো আমার সর্বনাশ করে গেলে। আমার মেয়েটাকে...

উনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি লাঠির বাড়ি খাওয়া নেড়িকুকুরের মতন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই দেখলাম, পিয়ালি মুখে আঁচলের খুঁট চাপা দিয়ে ফুলে ফুলে হাসছে। অবশ্য হাসিটা সামলেও নিল খুব তাড়াতাড়ি। বলল, চলো, ওদিকে গিয়ে বসি। আজ রাতটা থাকবে তো? তাহলে বাবাকে বলি, রতুদার দোকানে আরও ক'টা রুটি বাড়তি দেওয়ার কথা বলতে। রুটিই খাও তো রাতে?

জিগ্যেস করলাম, হোমপ্যাক কেন? তুমি রান্না করো না?

আমি আর আগুনের সামনে বসে রুটি বানাতে পারি না। কিছুই পারি না আমি আর। 

একটা হাহাকারের মতন, অজয়ের চরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা শুকনো হাওয়ার মতন, পিয়ালির এই কথাগুলো উঠোনের বুনো ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে মিলিয়ে গেল। 

হঠাৎ আমার খেয়াল হল, পিয়ালির কথাটার একটু ব্যাখ্যা নেওয়া ভীষণ জরুরি। বাইরে থেকে ওকে দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আজও ওর আঁচলের আড়াল ভেদ করে জেগে আছে অনম্র দুই স্তন, যেমন আগেও দেখেছি। ধোপার পাটের মতন মসৃণ মেদহীন তলপেটে গভীর নাভি—যেমন আগেও দেখেছি। কী এক ম্যাজিকের গুণে যেন কাল ওকে স্পর্শ করতে পারেনি। তবু মেয়েদের শরীরে কতরকমের গোপন রোগ যে থাকতে পারে, সেটা আমার বউকে দেখেই শিখেছি। যদি পিয়ালিও অসুস্থ হয় তাহলে আমি এখানে সেকেন্ড ইনিংস চালু করার প্ল্যানটা ক্যানসেল করে দেব। আমি মজা চাই। নতুন করে ঝক্কিঝামেলা চাই না। 

তবে প্রশ্নটা করতে হবে খুব সাবধানে। প্রশ্নের পেছনে লুকিয়ে থাকা ধান্দা যেন ধরতে না পারে। তাই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বললাম, না, পিয়ালি। আজ আমি একটু পরেই ফিরে যাব। কিন্তু একটা কথা জিগ্যেস করি। তোমাকে আজও ভালোবাসি বলেই জিগ্যেস করছি...রুটি বানাতে পারো না কেন? শরীর খারাপ? 

ও মুখ নীচু করে উত্তর দিল—শরীরে আর কিছু নেই তিনুদা। 

তারপর হঠাৎই বলল, শুধু ঠোঁটদুটো রয়েছে তিনুদা। আঠেরো বছর ধরে শুধু দুটো ঠোঁট তোমার জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছি। সেই যে চুমুটা তুমি খেতে চেয়েছিলে, খেতে পারোনি, সেই চুমুটা তোমাকে দেওয়া জন্যে।

আমি একটা কাঠের চেয়ারের ওপরে বসেছিলাম। পিয়ালি দাঁড়িয়েছিল আমার পিছনে, চেয়ারের পিঠের ওপরে দুটো হাত রেখে। ও হঠাৎ এগিয়ে এসে নিজের বরফের মতন ঠান্ডা দুটো হাতের তালুতে আমার মুখটা ধরে ওপরের দিকে ঘুরিয়ে দিল। আমি দেখলাম পিয়ালির শান্ত দুটো চোখ। দেখলাম পিয়ালি আর মাটিতে দাঁড়িয়ে নেই, সিলিং-এর হুকের সঙ্গে বাঁধা একটা রাবারের টিউব গলায় লাগিয়ে ঝুলছে। গলাটা এখন জিরাফের মতন লম্বা, তাই আমার ঠোঁটের নাগাল পেতে ওর অসুবিধে হচ্ছে না। 

বরফকুচির মতন দুটো ঠোঁট আমার ঠোঁটের ওপরে চেপে বসতেই আমি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ওর মুখটাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলাম। ওর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা রাবারের গন্ধে আমার আবার সস্তার কনডোমের কথা মনে পড়ে গেল—এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। আমি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে সদর দরজার দিকে দৌড়লাম। 

একটা কমবয়সি ছেলে হাতে রুটি তরকারির প্যাকেট নিয়ে সবেমাত্র দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি দৌড়ে বেরোতেই তার সঙ্গে ধাক্কা লাগল। সে অবাক গলায় প্রশ্ন করল—কী হল?

আমি হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম, এই বাড়িতে কে কে থাকেন জানো?

কে কে আবার কী? একজনই থাকেন তো, রথীন জেঠু। ওনার মেয়ে, মানে পিয়ালিদি তো সেই কবেই গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। তারপর কাকিমাও বোধহয় ওই শকেই মারা গেলেন। এখন উনি একেবারে নিরম্বু একা। আমি মাসকাবারিতে দুবেলার খাবার দিয়ে যাই।



বাসস্ট্যান্ডের দিকে জোরে পা চালাতে চালাতে ভাবলাম রতুদার দোকানের ছেলেটা একটু ভুল বলল। গলায় দড়ি নয়, গলায় রাবারের টিউব। টাইম-কলের জল চলে যাওয়ার পরেও যে টিউবটা ট্যাপের মুখে লাগিয়ে পাইপের ভেতর থেকে চুষে চুষে জল বার করত পিয়ালি, সেটাই গলায় জড়িয়ে ঝুলে পড়েছিল। আমি এলে জল একটু বাড়তি খরচ হত কিনা, তাই ওইভাবে পিয়ালি বালতি ভরত আর সারাদিন ওর মুখের ভেতরটা ভরে থাকতো রাবারের গন্ধে। 

আঠেরো বছর আগে ওকে প্রথমবারের জন্যে চুমু খেতে গিয়ে ওই গন্ধ সহ্য করতে না পেরেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। 



মেয়েটা এখনো মুখে সেই গন্ধ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।


Comments