তুলোবীজ
সৈকত মুখোপাধ্যায়
চৈত্রের এই দুপুরে বালুডাঙা শহরের আকাশে-বাতাসে প্রসন্নতা ছড়িয়ে রয়েছে। প্রসন্নতা ছড়িয়ে আছে শঙ্খদের বাড়ির পেছনের বাগানে। একটা টুনটুনি শিউলিগাছের এক পাতা থেকে অন্য পাতায় লাফ দিয়ে দিয়ে ঘুরছিল আর ক্রমাগত টুইটুই করে ডাকাডাকি করছিল। এইমাত্র সেটা উড়ে গেল সোমাদের বাড়ির দিকে। এখন বাগান প্রায় নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধ শঙ্খদের পুরো পাড়াটাই। শুধু সোমার ঠাকুমা রেডিয়োতে 'বোরোলিনের সংসার' চালিয়েছেন, তার আবছা শব্দ ভেসে আসছে।
শঙ্খ বাগানের লাগোয়া রোয়াকের থামে হেলান দিয়ে বসেছিল। হাতে সেইমাসের উল্টোরথ পত্রিকাটা ধরা ছিল ঠিকই, কিন্তু সে কিছুই পড়ছিল না। সে সোমার কথা ভাবছিল। ভাবছিল সোমা তাকে ভালোবাসে না। কেনই বা বাসবে?
সে নিজের অজান্তেই একবার হাতটা মাথায় বুলিয়ে আনল। বালুডাঙার কুয়ো কিম্বা টিউবওয়েলের জলে আয়রন খুব বেশি। লোকের চুল পড়ে যায়—কারুর কম কারুর বেশি। শঙ্খর যেমন এই একুশ বছর বয়সেই অর্ধেক চুল ফাঁকা হয়ে গেছে। ওর মা ক'দিন ধরে শোয়ার আগে মাথায় ভৃঙ্গরাজ তেল মালিশ করে দিচ্ছিলেন। তাতে কোনো ফল হয়নি। সে তাই ইদানীং চরম হতাশায় ডুবে আছে। শঙ্খ জানে, সোমা তাকে কোনোদিনই ভালোবাসবে না। একুশ বছরের একটা টেকো ছেলেকে কেউ ভালোবাসতে পারে না।
ওই তো...সোমা চানের পর ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। ফটাশ ফটাশ করে গামছা দিয়ে ভিজে চুল ঝেড়ে, গামছাটা তারে মেলে দিয়ে, ছাদ থেকে চলেও গেল একটু বাদে। যাবার আগে একবার কি আড়চোখে শঙ্খর দিকে তাকিয়েছিল মেয়েটা? তাচ্ছিল্য মাখানো ছিল কি সেই তাকানোর মধ্যে? শঙ্খর মনে হল, ছিল।
শঙ্খ ম্যাগাজিনটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। শুধু সোমাকে একপলক দেখার জন্যেই তার এইসময় পেছনের রোয়াকে এসে বসে থাকা। সোমা চলে গেছে। তারও আর এখানে বসে থাকার প্রয়োজন নেই।
ঠিক এই সময়েই ক্রিং ক্রিং করে বাড়ির সদর দরজার সামনে সাইকেলের বেল বেজে উঠল। শঙ্খ একরকম দৌড়িয়েই বৈঠকখানা পেরিয়ে সামনের রাস্তায় পৌঁছে গেল। যাবার আগে কলেজের ব্যাগ থেকে পাঁচটা টাকাও বার করে নিতে ভুলল না।
পোস্টম্যান ভদ্রলোক ততক্ষণে সাইকেল থেকে নেমে পড়েছেন। তিনি মুখ নামিয়ে খাকি কাপড়ের ব্যাগটার ভেতরে কী যেন খুঁজছিলেন। শঙ্খ তার সামনে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, এনেছেন?
মুখ তুলে অল্প হাসলেন নতুন পোস্টম্যান, অবশ্যই। আমি তোমাকে জিনিসটার কথা বললাম, আর আমিই ভুলে যাব?
শঙ্খ একটু অপ্রস্তুত গলায় বলল, না, তা নয়। মানে জিনিসটা পেয়েছেন কিনা সেটাই জিগ্যেস করছিলাম।
এই পোস্টম্যানের বয়স কম। লম্বা, ফরসা এবং রোগা। আগের জন ছিলেন মোটা এবং বয়স্ক। তিনি মারা যাওয়ার পর এই ভদ্রলোক পোস্টম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। এনাকে বালুডাঙার কেউ চেনে না, আগে দ্যাখেনি। এনার কানের পাতাদুটো খুলির সঙ্গে লেপটানো আর চোখগুলো বড় বড়। কিন্তু ওসব কিছু নয়। নতুন এই পোস্টম্যানের দিকে তাকালে প্রথমেই যা চোখ টেনে নেয় তা হল এনার মাথার চুল। শুধু ঘন নয় চুলগুলোর রং, জেল্লা সবই অন্যরকম। কারুর মাথায় এরকম চুল আগে কখনো দেখেনি শঙ্খ। তিনদিন আগে যখন সে এই নতুন পোস্টম্যানকে প্রথমবার দেখেছিল, তখনই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল—বাঃ। ফ্যানটাসটিক চুল তো আপনার।
উনি একবার শঙ্খর মাথার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, তোমার এরকম চুল চাই?
শঙ্খ মুখে কিছু বলেনি। শুধু বিব্রত মুখে মাথা নেড়ে জানিয়েছিল—না।
সে বুঝে গেছে, ওসব স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।
পাঁচটা টাকা খরচ করতে পারবে? তোমাকে আমি একটা জিনিস এনে দেব। আমিই তোমার হয়ে অর্ডার দিয়ে দেব, ভিপিতে মাল চলে আসবে। বিশ্বাস করবে, আমারও একসময় তোমার মতন টাক পড়ে গিয়েছিল? তারপর ওই জিনিসটার কল্যাণে...। পোস্টম্যান একবার নিজের ঠাসা চুলগুলোর মধ্যে হাতটা চালিয়ে, শঙ্খর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন উত্তরের আশায়।
শঙ্খ একটু ভেবে নিয়ে রাজি হয়ে গেল। ভৃঙ্গরাজের পয়সা মা দিয়েছেন। এই পাঁচটাকা নাহয় সে নিজের জমানো হাতখরচ থেকেই দেবে। বলা কী যায়, কিসের মধ্যে কোন ম্যাজিক লুকিয়ে থাকে?
সেদিনের সেই কথার সূত্র ধরেই আজ উনি শঙ্খর হাতে একটা মোটা বইয়ের মাপের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন। পাতলা পিজবোর্ডের তৈরি ক্যাটকেটে সবুজ রঙের প্যাকেটটা দেখে মোটেই ভক্তি হল না শঙ্খর। পোস্টম্যান বোধহয় মন পড়তে পারেন। বললেন, নতুন কোম্পানি, তাই প্যাকেট- ট্যাকেটগুলো এখনো ভালো করে বানিয়ে উঠতে পারেনি। তবে ওসব বাইরের চমক, ওসব কিছু নয়, ভেতরের জিনিসটা পৃথিবীতে এই প্রথমবারের জন্যে এল।
শঙ্খ প্যাকেটটা চোখের সামনে এনে জিগ্যেস করল, কী আছে ভেতরে? লোশন না ক্রিম?
পোস্টম্যান বললেন, ওসব কিছু না। একটা পাতলা প্লাস্টিকের তৈরি টুপির মতন জিনিস আছে। ওটা শোয়ার সময় মাথায় পরে নেবে, সকালে উঠে খুলে ফেলবে।
শঙ্খ আকাশ থেকে পড়ল। বলল, টুপি! টুপি পরে শুতে হবে! কদিন পরতে হবে?
একদিন। একদিন, মানে একটা রাত আর কি। অধৈর্য গলায় বললেন পোস্টম্যান।
তারপর শঙ্খর হাত থেকে নোটটা নিয়ে বললেন, শোনো ভাই, একটা কথা বলে দিই। টুপিটা পরার পর প্রথমটায় একটু চিনচিন করতে পারে। ভেতরে মাইক্রোস্কপিক নিডলস আছে। সেগুলোর মধ্যে দিয়ে স্কিনের নীচে জিনিসটা ঢুকে যায় তো, তাই। তবে একটু বাদেই তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। আর কিছু টের পাবে না।
শঙ্খ ইতস্তত করে বলল, বাবা! ভয় লাগছে তো শুনে। ঘা-টা হয়ে যাবে না তো?
পোস্টম্যান মুচকি হেসে বললেন, আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু না। ওসব কিছু হবে না। শুধু...।
শুধু কী?
তোমার জীবনটা বদলে যাবে।
শঙ্খর কানে এই শেষের কথাটা কেমন যেন শোনাল। সে পোস্টম্যানের মুখের দিকে তাকাল। শুধু চুল নয়, ওনার চোখদুটোও একটু অন্যরকম। মণির পেছনে যেন সরু সরু কিসের কিলবিলানি। শঙ্খ নিজে রোজ বাড়ির অ্যাকোরিয়ামের মাছেদের জন্যে একটা কাচের বালবের মধ্যে চিমটে দিয়ে ধরে ছোট্ট এক দলা কেঁচো রেখে দেয়। লোকটার চোখের মণি দেখে সেই কেঁচো-ভর্তি বালবটার কথা মনে পড়ে গেল শঙ্খর। সে পোস্টম্যানের হাত থেকে প্যাকেটটা নিল। তারপর আর কোনো কথা না বলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল।
পাঁচটা টাকা খরচ করতে পারবেন? এইরকম চুল আপনারও হবে।
শঙ্খর কথা শুনে ডক্টর শাসমলের বউ মন্দিরার চোখদুটো লোভে চকচক করে উঠল। শঙ্খকে তিনি চেনেন। ছেলেটা ভালো গিটার বাজায়। তার গানের সঙ্গেও দু-একটা ফাংশানে বাজিয়েছে। দু-মাস আগেও ছেলেটার মাথায় টাক ছিল। অথচ এখন মাথাভর্তি ঘন চুল। আর সে কী চুল! বুড়ো-আরশোলার ডানার মতন কালচে লাল রং। শুয়োরের ঘাড়ের রোঁয়ার মতন ঠাসা।
মন্দিরা বললেন, সত্যিকথা বল তো ভাই। উইগ পরিসনি তো?
ছুঁয়ে দেখুন! দেখুন না! শঙ্খ মাথাটা ঝুঁকিয়ে দাঁড়াল।
এই বয়সের ছেলের গায়ে হাত দেওয়া উচিত নয় জেনেও মন্দিরা নিজেকে সামলাতে পারলেন না। সদর দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তিনি ডানহাতের আঙুলগুলো শঙ্খর চুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।
তিনি বরের কাছে শুনেছিলেন, মানুষের চুল আসলে মৃত কোষ। কিন্তু কথাটা সম্ভবত ঠিক নয়। এই যে শঙ্খর চুলগুলো তার আঙুলগুলোকে জড়িয়ে ধরছে, আদর করছে—এ কি কোনো মৃত কোষের পক্ষে সম্ভব? চুলের গায়ে কি এত তাপ থাকে? দপদপ করে? কাঁপে? মন্দিরার মনে হল শঙ্খর মাথার প্রত্যেকটা চুল যেন জীবন্ত। কাটলে রক্ত বেরোবে।
তিনি হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, কী লাগিয়েছিলিস রে? কোনো লোশন? নাকি তেল?
না, ওসব কিছু নয়। একটা টুপি...এক রাত, মাত্র এক রাত পরে শুতে হবে। আমার কাছেই রয়েছে। যদি নিতে চান...।
মন্দিরা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, একটু দাঁড়া। আমি টাকাটা নিয়ে আসছি।
মন্দিরা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন। শঙ্খ কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে ভেতর থেকে সবুজ প্যাকেটটা বার করতে গেল। প্যাকেটের সঙ্গে একটা ভাঁজ করা কাগজ বেরিয়ে এল। এটা কী?
শঙ্খ কাগজটার ভাঁজ খুলে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে একটা চিঠি। শুরুতেই মেয়েলি ছাঁদে লেখা আছে 'প্রিয়তম'। কথাটার মানে কী? শেষে লেখা 'তোমার সোমা'। মানে কী? সোমা নামে একটা মেয়ের কথা আবছা মনে পড়ছে ঠিকই। কিন্তু তার তো এমনিতেই মাথাভর্তি চুল। তার সঙ্গে তো শঙ্খর কোনো লেনদেন থাকবার কথা নয়।
ক্রিং ক্রিং। সাইকেলের বেলের শব্দে মুখ ফিরিয়ে তাকাল শঙ্খ। রাস্তার ওপাশে পোস্টম্যান দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাকে ইশারায় কাছে ডাকছেন।
শঙ্খ সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পোস্টম্যান ঠান্ডা হিম গলায় বললেন, তোমাকে বলেছিলাম না, মেয়েদের হাতে এ জিনিস দিও না।
কেন? বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল শঙ্খ। কত কষ্ট করে সে একজন খরিদ্দার জোগাড় করেছিল। শুধু মহিলা বলে তাকে হাতছাড়া করতে হবে?
পোস্টম্যান একইরকম ঠান্ডাগলায় উত্তর দিলেন—মেয়েদের শরীরের ভেতরে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায়। উনি তো বিবাহিত। ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আরো প্রবল। চলো! পালিয়ে চলো এখান থেকে। আমার সাইকেলে উঠে বসো।
সেই আদেশ উপেক্ষা করতে পারল না শঙ্খ। পোস্টম্যানের সাইকেলের সামনের রডে উঠে বসল সে।
পোস্টম্যান সাইকেল থামালেন একেবারে ইটখোলার মাঠে পৌঁছিয়ে তারপর। এখানে চারিদিকে ধুধু জমি। আগের বছরের ইটের পাঁজা দুয়েকটা এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারই মধ্যে একটা বিরাট জলা।
প্রাকৃতিক জলা নয়। বালুডাঙার একপ্রান্তে মানুষের হাতে তৈরি ওরকম বড় বড় ভেড়ির মধ্যে নদীর জল এনে জমানো হয়। জলের নীচে পলি থিতিয়ে পড়লে সেই পলি দিয়ে তৈরি করা হয় একনম্বর পাগমিল ইট। তবে তার এখনো দেরি আছে। এখন তো সবে আষাঢ়। জল শুকোতে শুকোতে সেই আশ্বিন। তারপরে শীতকালে নতুন ইট তৈরির কাজ শুরু হবে।
আপাতত গভীর ভেড়ির ঘোলা জলে কোটি কোটি বুদবুদ ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। মাছ নয়। এই জলায় মাছ থাকে না। অন্য কিছুর নিশ্বাসের বুদবুদ।
একটা ইটের পাঁজার গায়ে সাইকেলটাকে হেলান দিয়ে রেখে জলার ধারে পা ছড়িয়ে বসালেন পোস্টম্যান। শঙ্খও তার পাশে গিয়ে বসল।
পোস্টম্যান বললেন, কী সুন্দর এই পৃথিবী। তাই না শঙ্খ?
শঙ্খ বলল, হ্যাঁ। খুব সুন্দর।
অথচ দেখো, মানুষ ভাবে এই পৃথিবী তার একার। আর কাউকে আসতেও দেবে না, থাকতেও দেবে না। মেরে সাফ করে দেবে। কিন্তু চিরকাল তো এরকম ছিল না।
ছিল না? সম্মোহিতের মতন প্রশ্ন করে শঙ্খ?
না। কোথায় ছিল? তুমি মাইটোকনড্রিয়ার কথা জানো?
মাইটোকনড্রিয়া? শব্দটা চেনা লাগল শঙ্খর।
পোস্টম্যান কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, মনে পড়ছে না? আমাদের কোষের মধ্যে যে মাইক্রোস্কোপিক বডিগুলো থাকে? 'পাওয়ারহাউস অব দা সেল' বলা হয় যাদের?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে।
ওরা তো অনেক-বছর আগে বাইরে থেকে এসেই মানুষের শরীরের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। এখনো ওরা মানুষের কোষের মধ্যে নিজেদের মতন করে সেল ডিভিশন করে চলেছে। ওদের ক্রোমোজোমের সঙ্গে মানুষের শরীরের অন্য কোনো কোষের ডি এন এ স্ট্রাকচার মেলেনা জানো তো?
জানতাম না। 'বাইরে থেকে এসে' মানে কী?
পৃথিবীর বাইরে থেকে এসে। তাতে কি কোনো ক্ষতি হয়েছে মানুষের?
শঙ্খ কোনো উত্তর দিল না। সে আজকাল পরিষ্কার করে কিছুই ভাবতে পারে না। মাথার মধ্যে সারাক্ষণ অন্য কারা যেন কথা বলে, গান গায়। কারা যেন বলে, 'চলো, চলো। ছড়িয়ে পড়ি। কী সুন্দর এই নীল গ্রহ। কী সুন্দর এই 'জল' নামের তরল। চলো, জলে নামি।
শঙ্খ পোস্টম্যানকে জিগ্যেস করল—আচ্ছা, আপনার আগে যিনি পোস্টম্যান ছিলেন, হরিপদবাবু, তিনি এই জলাটাতেই ভাসছিলেন না?
হ্যাঁ। হরিপদবাবু জলে ডুবে মরলেন বলেই তো আমি চাকরিটা পেলাম।
আপনিও কি একদিন মরে যাবেন? জলে ডুবেই মরবেন কি?
পোস্টম্যানের মাথার চুলগুলো হঠাৎ যেন ভীষণ ভয়ে কুঁকড়ে গেল। সে অবশ্য এক মুহূর্তের জন্যে। তার পরেই আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল সবকিছু। উনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, যদি তেমন কিছু ঘটে, তাকে মৃত্যু বোলো না। মৃত্যু বলে কিছু নেই। আছে শুধু রূপান্তর।
তারপর পোস্টম্যান তার কাঁধের ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা ছোট ডায়েরি বার করে শঙ্খকে বললেন, তুমি যাদের মাল বেচেছ তাদের নাম ঠিকানাগুলো বলে যাও। লিখে নিই।
শঙ্খ দেখল ওনার কানের ফুটোর মধ্যে দিয়ে হঠাৎ কিলবিল করে কয়েকটা চুল বেরিয়ে এসে অস্থিরভাবে নড়াচড়া শুরু করল। একটু বাদে আবার শামুকের শুঁড়ের মতন তারা ঢুকেও গেল যথাস্থানে। এর মানে কী শঙ্খ ঠিক বুঝতে পারল না। এরকম কি হয়? এরকম হওয়াটা কি স্বাভাবিক? কে জানে?
সে আর ওসব নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে, ব্যাগ থেকে একটা চারনম্বর বঙ্গলিপি খাতা বার করল। বলল, লিখে নিন। চড়কডাঙার দর্পণ দত্ত। লিচুবাগানের আয়ুব মণ্ডল। চণ্ডীতলার পঙ্কজ সাধুখাঁ।
পঙ্কজ সাধুখাঁ! চণ্ডীতলায় যার চালের আড়ত আছে? আর্তনাদ করে উঠলেন পোস্টম্যান। শঙ্খ খেয়াল করল, বুদবুদগুলো হঠাৎ মিলিয়ে গেল। ভেড়ির জল হয়ে উঠল সীসের পাতের মতন ভারী আর মসৃণ। যেন প্রচণ্ড উত্তেজনায় সেই জল নিশ্বাস চেপে অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করছে শঙ্খ কী বলে শোনার জন্যে।
পোস্টম্যান আবার প্রশ্ন করলেন, ওনাকে তুমি এই টুপি বিক্রি করেছ?
শঙ্খ একগুঁয়ের মতন জবাব দিল, তাতে কী হল? উনি তো মহিলা নন।
পোস্টম্যান তিতিবিরক্ত গলায় বললেন, না, মহিলা নন। শ্রেণীশত্রু। আড়তদার। জানো না, হিটলিস্টে ওনার নাম আছে? কতদিন আগে বিক্রি করেছিলে?
অনেকদিন। তা দু'মাস তো হবেই। আমতা আমতা করে উত্তর দিল শঙ্খ। উনি নিজেই আমাকে ডেকে হাতেপায়ে ধরে আমার নতুন চুলের গোপন রহস্য পেট থেকে বার করে নিলেন। বিশ্বাস করুন, আমি টুপি বিক্রি করতে চাইনি। কিন্তু উনি বললেন, ওনার মাথাজোড়া টাকের জন্যে এক ক্যাবারে ড্যান্সার ওনাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। শেষ অবধি রাজি হতেই হল। কিন্তু আবারও বলছি, তাতে কোন ক্ষতিটা হয়েছে?
এমন কোনো শরীরে আমরা ঢুকতে চাই না যেখানে অন্য কিছু ঢোকার সম্ভবনা রয়েছে। সে পেনিস-ই হোক কিম্বা ছুরি। তোমাকে তো সবকিছুই বুঝিয়ে বলেছিলাম।
শঙ্খ অবাক হয়ে শুনল, পোস্টম্যানের মুখ থেকে নয়, কথাগুলো আসছে তার নিজের মাথার ভেতর থেকে।
একটা প্রবল দীর্ঘশ্বাসের মতন আওয়াজের সঙ্গে ভেড়ির স্থির জলতল বুদবুদের তোড়ে লাফিয়ে উঠল।
স্যার! স্যার!
পাগলা পার্থ দৌড়ে এসে ডক্টর শাসমলের রাস্তা আগলে দাঁড়াল।
পার্থ ব্যানার্জি ডাক্তার শাসমলের প্রতিবেশী। খুব বনেদি বাড়ির ছেলে। বদ্ধ পাগল নয় যাকে বলে ছিটগ্রস্ত, তাই। পার্থ সায়েন্স ফিকশনের পোকা। ডাক্তার শাসমলের ধারণা ওই আজগুবি গল্পগুলো পড়েই ওর মাথার স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে। প্রতিবেশীদের মধ্যে একমাত্র মন্দিরা আর ডাক্তার শাসমলই ওকে একটু প্রশ্রয় দেন। তাই ওর গ্রহান্তরের জীব নিয়ে উদ্ভট সব আইডিয়াগুলোও ওদের দুজনকেই গিলতে হয়।
মাসকাবারি রিকশাওলা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তারবাবু হাসপাতালে যাবেন বলে রিকশায় উঠতে যাচ্ছিলেন। অন্য কেউ হলে এইসময়ে পার্থর পাগলামি দেখে খেপে যেত। কিন্তু ডাক্তার প্রাণবিন্দু শাসমলের মনটা মায়ায় ভরা। তিনি পার্থর কাঁধে হাত রেখে হাসতে হাসতে জিগ্যেস করলেন, কী হল? আজ আবার কী প্রবলেম?
আমাদের বালুডাঙায় স্যার দুটো সেলুন—একটা ব্রজেনদার কেশশ্রী, অন্যটা ভূতনাথের কেশকলা। দুটো সেলুনে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, মোট তিয়াত্তরজন লোক চুল কাটা ছেড়ে দিয়েছে।
ডাক্তারবাবু রিকশার পাদানিতে একটা পা তুলে বললেন, সেটার মধ্যে কোনো রহস্য নেই। ওরা নিশ্চয় অন্য কোনো শহরের সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে আসছে।
ব্যাপারটা তা নয় স্যার। আমি ওয়াচ করে দেখেছি, ওদের চুল বাড়ে না। ওই যাদের টাকে নতুন করে চুল গজিয়েছে।
মে বি দোজ আর নট রিয়েল হেয়ার। মে বি সিনথেটিক ইমপ্ল্যান্টস। যাই হোক, ওসব নিয়ে বেশি ভেব না।
ভাবতে বারণ করলেন ঠিকই, কিন্তু পার্থর মাথা থেকে তবু ভাবনা যাচ্ছিল না। পাঁচ টাকায় সিন্থেটিক ইমপ্ল্যান্টস! সে কি হতে পারে? হঠাৎ অন্য একটা কথা মনে পড়তে সে আবার ঘুরে এল। বলল, আরেকটা কথা স্যার। আমরা ভাবি আকাশ থেকে শিমূলগাছ নেমে আসবে...
ভাবি নাকি? চরম ব্যস্ততার মধ্যেও পার্থর কথা শুনে হেসে ফেললেন ডক্টর শাসমল।
পার্থ অধৈর্য স্বরে বলল, ওঃ, আই ওয়াজ সিম্পলি ইউজিং আ মেটাফোর। আমরা ভাবি আকাশ থেকে বিশাল ফ্লাইং সসার নেমে আসবে। রে-গান নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে এলিয়্যানস এসে মানুষকে শেষ করে দেবে। কিন্তু স্যার, কখনো ভেবে দেখেছেন কি, আকাশ থেকে তো শিমূল গাছ নেমে আসে না। যা আসে তা হল শিমূলের বীজ। ছোট ছোট উড়ন্ত তুলোর টুকরোয় চেপে তারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর তো গাছ। তারপর তো মহীরুহ।
ডক্টর শাসমল রিকশাওলাকে রওনা হওয়ার ইশারা করলেন। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, দেরি হয়ে যাচ্ছে পার্থ। বাকি কথা পড়ে শুনব।
পার্থ পেছন থেকে চিৎকার করে বলল, স্যার, আমি কিন্তু একটা ভয়ঙ্কর বিপদের ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি। আপনি সাবধানে থাকবেন স্যার।
থাকব থাকব। চলে যেতে যেতে হাত তুলে বললেন ডাক্তার শাসমল। তার মনটা দমে গেল। পাগলরা নাকি অনেক কিছুর পূর্বাভাস পায়। পার্থ তাকে সাবধানে থাকতে বলল কেন?
মুন্সীবাড়ির গলির মধ্যে দিয়ে ডাক্তারবাবুর রিকশা যাচ্ছিল। তারপর ব্যানার্জিপাড়ার রাস্তা। তারপর আবার চকবাজার বাইলেন। ডাক্তারবাবু বিরসমুখে দেখছিলেন প্রত্যেকটা গলি, প্রত্যেকটা ছোট রাস্তার দেয়াল ভরে উঠেছে শ্লোগানে। চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। শ্রেণীশত্রু নিপাত যাক।
বালুডাঙার আকাশে চৈত্রমাসে যে প্রসন্নতা ছড়িয়ে ছিল, সেই প্রসন্নতা এই আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে গেছে। এখন রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় পেটোর আওয়াজে। গত সপ্তাহে ওরা মহাকালি বালিকা বিদ্যালয়ের হেডমিস্ট্রেস অঞ্জলিদির গলায় ছুরি ধরে কোশ্চেনপেপার লুঠ করে নিয়ে গেছে। কী হচ্ছে কী এসব?
এখন প্রায় প্রতিরাতেই এখানে ওখানে এক দুটো লাশ পড়ে। পরের দিন দুপুরে সেই লাশ পৌঁছে যায় হাসপাতালের মর্গে। রাউন্ড সেরে সন্ধের দিকে ডক্টর শাসমল ইনকোয়েস্ট শুরু করেন।
ইনকোয়েস্টের আর আছেটা কি? সেই স্ট্যাবড টু ডেথ। ইনজুরি ওয়জ কজড বাই সাম শার্প ওয়েপন। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু। ডাক্তারদের ইনকোয়েস্ট ওপর-ওপর এইটুকুই বলতে পারে। মৃত্যুর যথার্থ কারণ বলতে পারবেন পলিটিশিয়ানরা। ছুরির হাতল ধরে থাকে যে হাতগুলো, সেই হাতের পেছনে বিষিয়ে ওঠা মনগুলোকে শনাক্ত করা কোনো ডাক্তারের কম্ম নয়।
সন্ধেবেলায় রাউন্ড সেরে বেরিয়ে ডক্টর শাসমল দেখলেন বারান্দার নীচে বাসু ডোম দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি বললেন, কী রে বাসু? আজকেও?
বাসু চুল্লুজড়ানো গলায় বলল, হ্যাঁ, স্যার। একটাই বডি রয়েছে। আমি চিরে দিয়ে এসেছি। আপনি দেখে নিলে সেলাই করে দেব। আমি স্যার একটু ঘুরে আসছি। আধঘণ্টার মধ্যে চলে আসব।
ডক্টর শাসমল ঘাড় নেড়ে বাসুকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। এটা বাসুর নিত্যকর্মের মধ্যে পড়ে। এই আধঘণ্টায় ও মৃতের আত্মীয়দের সঙ্গে দরাদরি সেরে আসবে। ডেডবডি ঠিকঠাক বানিয়ে তাদের হাতে তাড়াতাড়ি তুলে দেওয়ার মূল্য বুঝে নেবে। এসব ওপেন সিক্রেট। সরকারি হাসপাতালে এসব সিক্রেটের দিকে তাকাতে নেই।
ডক্টর শাসমল একাই মর্গের দিকে রওনা দিলেন। হাসপাতাল বাড়ির থেকে অনেকটা দূরে, একটা বড় ডোবার পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মর্গটা। সামনের দিকে দরজা। পেছনের দিকে দেয়ালের একটু ওপরদিকে একটা গরাদ লাগানো জানলা। ব্যস। একজস্ট ফ্যান নেই, এয়ার কন্ডিশনার নেই। তাই খুব সহজেই ডেডবডি রট করে যায়। নরক হয়ে ওঠে ঘরের ভেতরটা।
ডক্টর শাসমল দরজার সামনে বাইরে থেকে টেনে দেওয়া হুড়কো খুলে ঘরটার ভেতরে ঢুকলেন। অভ্যেসমতন মাস্কটা পকেট থেকে বার করে নাকের ওপর বেঁধে নিতে গিয়েও থেমে গেলেন। অন্যান্যদিন লাশকাটা ঘরের দরজা পেরোলেই যে দুর্গন্ধটা নাকে ভক করে এসে লাগে সেই গন্ধটা আজ নেই। লাশ আছে তো সত্যিকারে? নাকি বাসু নেশার ঘোরে ভাট বকে গেল?
মাস্কটা ডাক্তারবাবুর হাতেই ধরা থাকল। তিনি সাবধানে বেশ বড় করে একটা শ্বাস টানলেন। পচা গন্ধ নেই ঠিকই, কিন্তু অন্য একটা গন্ধে ঘর ভরে আছে। বেশ চনমনে, চেনা-চেনা একটা গন্ধ। কিছুক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়েই তিনি ভাববার চেষ্টা করলেন, গন্ধটা এর আগে কোথায় পেয়েছিলেন।
হঠাৎ-ই মনে পড়ল। গতবছর পুজোয় কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে পহেলগামের তৃণভূমিতে পা ছড়িয়ে বসেছিলেন তিনি আর মন্দিরা। তাদের দুজনকে ঘিরেছিল মাইলের পর মাইল হিমে ভেজা তাজা সবুজ ঘাসজমি আর সেই ঘাসের ওপর শয়ে-শয়ে ভেড়া চড়ছিল। ভেড়ার লোমের গন্ধ আর তাজা ঘাসের গন্ধ মিলেমিশে একটা অদ্ভুত প্রাণবন্ত গন্ধে সেদিন পহেলগামের বাতাস ভারী হয়ে ছিল। এই গন্ধটা অনেকটা সেই গন্ধের কাছাকাছি। কোনো অ্যানিমাল ফাইবারের গন্ধ।
ডক্টর শাসমল পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন ঘরের মাঝখানে লোহার খাটটার কাছে। খাটের ওপরে নামানো আছে সাদা চাদরে ঢাকা ডেডবডি। একপাশে একটা ক্লিপবোর্ডে মৃতের কাগজপত্র। মাথার ওপরে হ্যাজাক ল্যাম্পটার দম কমে এসেছিল। সেই অল্প আলোয় ডক্টর শাসমল কাগজটার ওপর চোখ বোলালেন। তার মুখ দিয়ে অস্ফুটে কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এলো। মাই গুডনেস। পঙ্কজ সাধুখাঁ! শেষ অবধি ওরা শ্রেণীশত্রুকে হাতে পেল তাহলে?
হাতে গ্লাভস গলিয়ে তিনি আস্তে করে মৃতদেহের ওপর থেকে সাদা চাদরটা সরিয়ে দিলেন। উলঙ্গ দেহটা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। ডক্টর শাসমলের ভুরু দুটো কুঁচকে গেল। শেষবার যখন লোকটাকে দেখেছিলেন তখন মাথাজোড়া টাক ছিল। এখন ইবোনি কালারের ঘন চুলে মাথা ভরা। এই লোকটাও তাহলে পার্থর সেই রহস্যময় মানুষের তালিকায় নাম লিখিয়েছিল?
ডাক্তারবাবুর চোখ সাধুখাঁর মাথা থেকে নেমে এল গলায়। গলার বাঁদিকে প্রায় দু-ইঞ্চি চওড়া একটা জায়গা হাঁ হয়ে রয়েছে। ওইখানেই মরণ-মারটা মেরেছে। স্ট্যাবিং অ্যাজ ইউজুয়াল। আর কী হবে? একটা ছোট স্কেল তুলে নিয়ে ডক্টর শাসমল ক্ষতের দৈর্ঘ্য প্রস্থ আর গভীরতার মাপ নিয়ে কাগজে টুকে রাখলেন। এরপর দেহকাণ্ডের ভেতরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই কাজ শেষ।
বাসু তার চপারের মতন বড় ছুরি দিয়ে গলা থেকে তলপেট অবধি চামড়া আর পেশীর চাদর চিরে দিয়ে চলে গেছে। ডক্টর শাসমল বড় সাঁড়াশিটা তুলে নিলেন। তারপর বুকের পাঁজরগুলো চাড় দিয়ে ওলটাতে শুরু করলেন। নেহাত নিয়ম বলেই ভেতরটা দেখতে হচ্ছে। একবার ছেঁড়া, আর একবার সেলাই করা। পুরো ব্যাপারটাই ফার্স।
ফার্স কি সত্যিই? পঙ্কজ সাধুখাঁর বুকের ভেতর নজর না চালালে কি এই দৃশ্য তিনি দেখতে পেতেন? এই যে শরীরের পুরো গহ্বর জুড়ে রাশি রাশি জীবন্ত তন্তু কিলবিল করছে, এ কি ফার্স? এই যে, সেই তন্তুগুলোরই ওপরের অংশ মাথার খুলি ফুঁড়ে ওপরে উঠে গেছে, ঘন চুল সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাধুখাঁর খুলির ওপরে, সে-ও কি ফার্স?
ডক্টর শাসমলের চোখের সামনেই এবার সেই জীবন্ত তন্তুগুলো সাধুখাঁর শরীরের খোল থেকে বেরিয়ে সাপের মতন ঢেউখেলানো চালে চলতে শুরু করল জানলাটার দিকে। মনে হচ্ছিল একটা মোটা বিনুনি কোনো রূপসীর মাথা থেকে নেমে নিজের ইচ্ছেয় দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করে দিয়েছে। দেখতে দেখতে কুণ্ডলী পাকানো পোকাগুলো ঘর থেকে বেরিয়ে ডোবাটার দিকে রওনা হল। ডক্টর শাসমল জানলার মধ্যে দিয়ে বাইরে চলকে পড়া হ্যাজাকের আলোয় ওদের জলযাত্রা দেখতে পাচ্ছিলেন।
কিছুক্ষণ হতভম্বের মতন সেদিকে তাকিয়ে থেকে তারপর তিনি আবার ঘুরে দাঁড়ালেন সাধুখাঁর ডেডবডির দিকে। এখন সেই ডেডবডির মাথায় আবার পুরোনো টাক ফিরে এসেছে, কিন্তু ফেরেনি তার হার্ট লাং কিডনি লিভার স্টমাক। কসাইখানায় টাঙিয়ে রাখা পেট-চেরা খাসির মতন সাধুখাঁর শরীরের ফাঁকা খোলটা ওই লোহার খাটের ওপর পড়ে রয়েছে।
ডাক্তারবাবু ভাবলেন, তার মানে অনেকদিন আগেই সাধুখাঁ মারা গিয়েছিল? তার শরীরটাকে চালিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল এই প্যারাসাইটগুলো! পঙ্কজ সাধুখাঁর কথাবার্তা, কাজকর্ম বলে আশেপাশের মানুষ যাকে ভুল করছিল তা এই অদ্ভুত পোকাগুলোর কথাবার্তা? এদেরই কাজকর্ম?
একদম পিঠের কাছেই আলতো পায়ের শব্দে ডক্টর শাসমলের চিন্তায় ছেদ পড়ল। তিনি বিদ্যুতগতিতে ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেন কখন যেন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এসেছে দুটো লোক। দুজনেই তার চেনা। শঙ্খ বলে সেই গিটারিস্ট ছেলেটা আর বালুডাঙার নতুন পোস্টম্যান।
তিনি দেখলেন, শঙ্খর মুখের ভেতর দিয়ে চুলের স্রোত বেরিয়ে হ্যাজাকের আলোটাকে ঘিরে ধরছে। লাশকাটা ঘরটা গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারলেন, ওরকমই আরেকটা ঘন বিনুনি পোস্টম্যানের হা করা মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তার গলাটাকে পেঁচিয়ে ধরল।
মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে ডক্টর শাসমল পৃথিবীর আকাশে রাশিরাশি তুলোবীজ উড়তে দেখেছিলেন।
Comments
Post a Comment