পাশা
সৈকত মুখোপাধ্যায়
অপূর্ব ব্যানার্জির বয়স বত্রিশ। সে অবিবাহিত, কিন্তু তার প্রথম রিপুটি অবদমিত নয়। উত্তর কলকাতার বাসিন্দা অপূর্বকে কাজের খাতিরে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গায় তো বটেই, ভারতের নানান শহরেও দৌড়ে বেড়াতে হয়। এর মাঝে যখনই সে বিশ্রাম করে তখনই তার সঙ্গে সঙ্গিনী থাকে।
অপূর্বর জীবিকা-টাও বেশ অপূর্ব। সে ইন্ডিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একজন নাম করা 'প্রপ-সাপ্লায়ার'। সিনেমার শ্যুটিং-এর সময় সেটটাকে পরিচালকের মনের মতন করে সাজানোর জন্যে হাজার রকমের জিনিসের দরকার পড়ে। সেগুলোকেই বলে 'প্রপ'। আর পয়সার বিনিময়ে পরিচালকদের হাতে সেগুলোকে তুলে দেওয়াই হল 'প্রপ-সাপ্লায়ারের' কাজ।
অবশ্য একটা সাধারণ সিলিং-ফ্যান কিম্বা ঝুলঝাড়ুর দরকার পড়লে কেউ অপূর্ব ব্যানার্জির কাছে আসে না। কিন্তু যখন একটা অরিজিনাল রবি বর্মার পেইন্টিং কিম্বা উনিশশো ছত্রিশ সালের মোটরগাড়ির দরকার পড়ে তখন বলিউড আর টলিউডের বহু নামজাদা সিনেমা-পরিচালকই অপূর্বর শরণাপন্ন হন। কারণ তাঁরা জানেন, তাকে দায়িত্ব দিলে সে দৌড়ঝাঁপ করে জিনিসটা ঠিক জোগাড় করে দেবে। এ ব্যাপারে ওর অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে।
তাই আজ থেকে ঠিক বাইশ দিন আগে বলিউডের বিখ্যাত পরিচালক গগন দেশমুখ এই অপূর্ব ব্যানার্জিকেই ফোন করে বললেন, দ্যাখো ভাই অপূর্ব। যুধিষ্ঠিরকে হিরো করে একটা টিভি সিরিয়াল বানাচ্ছি। শকুনি আর যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলার সিন থাকবে। কাজেই একটা বেশ রাজকীয় পাশা লাগবে। এক মাসের মধ্যে জিনিসটা আমার চাই।
অপূর্ব ব্যানার্জি খেপে গিয়ে বলল, এমন এমন জিনিস আনতে বলেন না গগনভাই! কোনদিন হয় তো একটা জ্যান্ত জটায়ু পাখি চেয়ে বসবেন। ওসব পাশা-টাশা নিয়ে কি এখন কেউ খেলা করে, যে জোগাড় করে দেব? তার চেয়ে আপনার আর্ট ডিরেক্টরকে বলুন না, পিজবোর্ড রাঙতা-টাঙতা দিয়ে একটা বানিয়ে দেবে।
গগন দেশমুখ একটুও না রেগে বললেন, আরে ভাই, বুঝছ না কেন? কপি করতে গেলেও তো অরিজিনাল জিনিসটাকে চোখের সামনে দেখতে হবে। ওই যোগ চিহ্নের মতন দেখতে বোর্ড, চৌকোণা সব ঘুঁটি—না দেখে বানানো যায় না কি? আমি কোনো আপত্তি শুনব না। তোমাকে জোগাড় করে দিতে হবে। খরচার জন্যে ভেবো না। কত লাগবে বলো?
ঝোঁকের মাথায় অপূর্ব ব্যানার্জি বলে ফেলল, পঞ্চাশ হাজার। তার কমে পারব না।
ডান। পঁচিশ হাজার টাকা কালকেই তোমার অ্যাকাউন্টে ট্র্যান্সফার করিয়ে দিচ্ছি। বাকিটা ডেলিভারির সময় পেয়ে যাবে। ঠিক আছে?
ঠিক না থেকে আর উপায় কী? এতগুলো টাকার মায়া তো আর ছাড়া যায় না। অতএব অপূর্ব খোঁজখবর করতে শুরু করল। কেউই কোনো খবর দিতে পারে না। শেষে গত পরশু, মুর্শিদাবাদের এক এজেন্ট ফোন করে জানাল, ওই জেলারই প্রীতমপুর-রাজবাড়িতে একটা বহু পুরোনো পাশা খেলার ছক, ঘুঁটি-টুটি সমেত, সংরক্ষিত আছে। অগত্যা চল প্রীতমপুর।
অপূর্ব নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে নিয়ে চলল। বহরমপুর পৌঁছোতেই বেলা বারোটা বেজে গেল। খোঁজখবর নিয়ে দেখল বহরমপুর থেকে প্রীতমপুর আরো চল্লিশ কিলোমিটার। রাস্তার হাল জঘন্য। তার ওপরে কোথাও কোনো ইন্ডিকেশন নেই। দুবার রাস্তা হারিয়ে, ফালতু অনেক বাড়তি চক্কর কেটে, শেষমেষ যখন প্রীতমপুরে পৌঁছোল তখন বিকেল হয়ে গেছে।
চারিদিকের দৃশ্য দেখে অপূর্বর মনটা দমে গেল। সারা তল্লাট জুড়ে বাঁশঝাড়, পানা-পুকুর, খেজুরগাছ। তারই মধ্যে গোটা চল্লিশেক খোড়ো চালের কুঁড়েঘর নিয়ে প্রীতমপুর গ্রাম। এরকম পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এক রাজামশাই যে কোন দুঃখে রাজবাড়ি বানাতে এসেছিলেন সেটাই অপূর্বর মাথায় ঢুকছিল না। তবে বানিয়েছিলেন যে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বিশাল এক ডায়নোসরের ফসিলের মতন ভাঙাচোরা রাজবাড়িটা দু-মাইল দূরের বাস-স্ট্যান্ড থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
আর দেরি না করে অপূর্ব সেদিকে পা চালাল।
যেতে যেতে অপূর্ব অবাক হয়ে দেখছিল, শুধু যে রাজবাড়িটিই ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে তাই নয়। গ্রামের সীমানার বাইরে, এখানে ওখানে, ওরকম বহু ভাঙাচোরা বাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিশাল দুটি দিঘিও সে পেরিয়ে এল, যেগুলোর পাড় এককালে পুরোনো আমলের ছোট ইট দিয়ে সুন্দর করে বাঁধানো ছিল। এখন অনেকটাই ধ্বসে পড়েছে। বড় বড় আমবাগান, তাও এখন ঝোপঝাড়ে ভর্তি। তাদের সীমানা-পাঁচিলের অনেকটাই লোপাট। পুরোনো গোরস্থান, পরিত্যক্ত বিশাল ইঁদারা—দেখলে মনে হয় পুরো জায়গাটাই যেন বহু যুগ ধরে মাটির নীচে চাপা পড়েছিল সম্প্রতি কোনো প্রত্নতাত্বিক মাটি খুঁড়ে সেই বিলুপ্ত জনপদকে উদ্ধার করেছেন।
একটু আগে যে প্রশ্নটা অপূর্বর মনে জেগেছিল, সেটার উত্তর এইভাবেই সে পথ চলতে চলতে পেয়ে যাচ্ছিল। প্রীতমপুরের যে গ্রাম সে একটু আগে পেরিয়ে এল, সে গ্রামের পত্তন হয়েছে পরে। তার অনেক আগে প্রীতমপুর এক বর্ধিষু শহর ছিল। রাজা ছিলেন সেই শহরেরই রাজা, এখনকার ওই অজ গ্রামের নয়।
কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই আরেকটা প্রশ্ন মাথা চাড়া দিচ্ছিল। ঘরবাড়ির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কোনোটাই দুশো বছরের বেশি পুরোনো নয়। এই অল্প সময়ের মধ্যে একটা জায়গা এভাবে উজাড় হয়ে গেল কেমন করে?
এই প্রশ্নের উত্তরটা পেতে তাকে রাত অবধি অপেক্ষা করতে হল। তার আগে সে রাজবাড়ির ভগ্নস্তূপের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। দেখেছে সেখানে জনমানব নেই, তবে রাজবাড়ির পেছনের মাঠে একলা দাঁড়িয়ে রয়েছে এক মন্দির—মুক্তকেশী কালীর মন্দির। আর সেই মন্দিরের লাগোয়া জরাজীর্ণ একতলা বাড়িটায় একজন প্রৌঢ় আর এক যুবতী বাস করছেন। তাঁরা হলেন যথাক্রমে জ্ঞানাতীত ভট্টাচার্য, ওই মন্দিরের পুরোহিত, আর তাঁর মেয়ে রক্তিমা।
না, ও-বাড়িতে আর কেউ থাকে না। রক্তিমার মা মাত্র ছ'মাস আগে মারা গিয়েছেন, সে কথা এ বাড়িতে ঢোকার একটু পরে জ্ঞানাতীত ভটচাজ-ই অপূর্বকে জানিয়েছিলেন।
অপূর্বকে বাধ্য হয়েই সেই রাতে জ্ঞানাতীত ভট্টাচার্যর আতিথ্য গ্রহণ করতে হল। কারণ পথে ডাকাতের ভয় আছে। অত রাতে কলকাতায় ফেরাটা ঠিক হত না। সে ঠিক করল, পরদিন সকালবেলায় ফিরবে।
পুরোহিতমশাইয়ের বাড়ির পুরোনো ইঁদারার জলটা ছিল হিম শীতল। সেই জলে স্নান করতেই পথশ্রম অর্ধেক উধাও হয়ে গেল। রক্তিমার নিজের হাতে বানানো সাদা ময়দার লুচি আর ছানার ডালনা পেটে পড়তে বাকিটাও গায়েব। তারপর বাকি থাকে কাজের কথা, এবং সেই পর্ব-টা এত সহজে মিটল যে অপূর্ব নিজেও অবাক। জ্ঞানাতীত ভট্টাচার্য অপূর্বকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন মুক্তকেশীর মন্দিরে। আড়াইশো বছরের পুরনো পাথরের মন্দির। ভেতরটা স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকার। কষ্টিপাথরের তৈরি ভয়ঙ্করী কালীমূর্তি। সামনে একটা বড় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছিল। মূর্তির পায়ের কাছে এক লোহার সিন্দুকের চাবি খুলে পুরোহিতমশাই বার করে আনলেন সেই পাশার বাক্স।
বাক্সটাই আসলে খেলার ছক। চারদিক থেকে চারটে রুপোর হুক খুলে দিতেই বাক্সটা চ্যাপ্টা হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। পার্চমেন্টের মতন নরম কোনো একটা জিনিস দিয়ে ছকটা বানানো হয়েছে। প্রাচীন পুথির পুষ্পিকায় যেমন বহু বর্ণের অলংকরণ দেখা যায়, সেরকম অলঙ্করণে পুরো ছকটা সাজানো। শুধু অলংকরণের বিষয়বস্তু বড় বেশি 'ইরোটিক'। নানান আসনে আবদ্ধ নগ্ন নারীপুরুষের মিথুনদৃশ্যে পুরো পটটাই ভরে রয়েছে। এই পাশাকে অনায়াসে বাৎস্যায়নের কামসূত্রের ইলাস্ট্রেশন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
তবে একটা কথা ভেবে অপূর্ব একটু আশঙ্কিত হল। যুধিষ্ঠিরের মতন এক সাত্ত্বিক চরিত্রের সামনে গগন দেশমুখ এই পাশার ছক পাততে পারবে তো?
পরক্ষণেই সে মনে মনে বলল, চুলোয় যাক দেশমুখ। দেশমুখ নিতে না চাইলে সে এই অমূল্য অ্যান্টিককে বিদেশমুখ করে দেবে। সোজা বাংলায়, পাচার করে দেবে কোনো বিদেশী অ্যান্টিক সংগ্রাহকের কাছে। তাতে তার লাভ কিছু কম হবে না।
এরপর যখন জ্ঞানাতীত ভটচাজ পাশার ঘুঁটিগুলোকে তার সামনে ছড়িয়ে দিলেন তখন অপূর্ব একেবারে হতবাক হয়ে গেল। ঘিয়ে রঙের আয়তাকার ঘুঁটিগুলো নিশ্চয় হাতির দাঁতের তৈরি, আর যদিও মুর্শিদাবাদের হস্তিদন্ত-শিল্পের ব্যাপারটা অপূর্বর অজানা ছিল না, তবু আইভরির ওপরে এত সূক্ষ্ম কারুকাজ যে কোনো কারিগর খোদাই করতে পারে এ কথা সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এ যেন বালুচরি শাড়ির আঁচলের নকশা। কোনোরকমে পাশার দিক থেকে চোখ সরিয়ে অপূর্ব জ্ঞানাতীত ভটচাজের মুখের দিকে তাকাল। তিনিও পাশাটার দিকেই তাকিয়েছিলেন।
তবে তাঁর মুখের রেখায় রেখায় মুগ্ধতা নয়, ফুটে উঠেছিল ভয়। কেন, কে জানে?
অপূর্ব সরাসরি বলল, এই পাশাটা আপনি আমাকে বিক্রি করুন। তার জন্যে যা দাম চাইবেন আমি দেব।
না, না। বিক্রি নয়, বিক্রি নয়। এটা...এটা আপনি এমনিই নিয়ে যান। নিয়ে আমাকে বাঁচান।
হতবুদ্ধি অপূর্ব পুরোহিতমশাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে বলল, মানে?
বলছি। আপনাকে সব কথা বলছি। আগে ঘরে চলুন। এই জিনিসটাকে বাইরে রাখতে আমার সাহস হয় না।
হঠাৎ-ই মনে হল একটা হাতের ছায়া পাশার ছকটার ওপর দিয়ে চলে গেল।
দেখলেন? দেখতে পেলেন? প্রায় চিৎকার করে উঠলেন জ্ঞানাতীত ভট্টাচার্য।
ছায়াটার কথা বলছেন? ও কিছু না। প্রদীপের সামনে দিয়ে কোনো পোকা মাকড় উড়ে গেল নিশ্চয়। ঠিক আছে, চলুন, ঘরেই যাই।
লোহার সিন্দুকের মধ্যে ঘুঁটিসমেত পাশাটাকে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করলেন প্রৌঢ় পুরোহিত। তারপর সাষ্টাঙ্গে দেবীকে প্রণাম করে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, সবই তোমার ইচ্ছা মা।
মন্দির থেকে ফিরে আসার পর, জ্ঞানাতীত ভটচাজের বাইরের ঘরের জলচৌকিতে বসে তাঁর কথা শুনছিল অপূর্ব। জ্ঞানাতীত ভটচাজ বলে চলেছিলেন—
রাজা প্রীতম সিং-এর নামেই মহালের নাম প্রীতমপুর। 'রাজামশাই' বলে বটে লোকে, তবে আসলে প্রীতম সিং ছিল রাজপুত বেনিয়া। উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ এদের কথা ইতিহাসে পড়েছেন তো? ওদেরই সমসাময়িক। তার আসল ব্যবসা ছিল তেজারতি, মানে সুদে টাকা ধার দেওয়া। প্রয়োজনে মুর্শিদাবাদের নবাবকেও টাকা ধার দিত। তাছাড়া বিনা ট্যাক্সে ব্যবসা করার সুলতানী ফরমান বেআইনিভাবে হাত বদল করত। এই সব করে অল্প সময়েই প্রচুর পয়সা করে ফেলেছিল।
তবে জগৎ শেঠ বা উমিচাঁদরা ছিলেন সংযমী, আর প্রীতম সিং উচ্ছৃঙ্খল। পঞ্চ 'ম'কারের প্রায় সবক'টাতেই ছিল ভয়ঙ্কর আসক্তি। তাই লক্ষ্মী যত তাড়াতাড়ি তার ঘরে এসেছিলেন, তার চেয়েও তাড়াতাড়ি বিদায় নিলেন। শেষ দিকে জুয়া খেলে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাতে উল্টে আরো তাড়াতাড়ি ফতুর হল।
পাশাটা কি তাহলে...?
ঠিক ধরেছেন। প্রীতম সিং-এর পাশা। ওই ছকেই বাজি রেখে জুয়া খেলা হত বলে শুনেছি।
তারপর?
দেখুন, আমার আদি বাড়ি তো এদিকে নয়। সবে বছর দুই হল এসেছি। তাই খুব বিশদে কিছু বলতে পারব না। তবে শুনেছি ওই খেলার জন্যেই কোনো এক হতভাগ্য প্রীতম সিং-এর হাতে খুন হয়েছিল।
খুন!
হ্যাঁ। বোধহয় তার কর্মচারীদের মধ্যেই কেউ হবে। একদিন নিজের সমকক্ষ কাউকে সঙ্গী না পেয়ে প্রীতম সিং ঝোঁকের মাথায় তাকে ডেকে খেলতে বলে। এলেবেলে ভাবে শুরু করেছিল। তারপর দেখা গেল সেই নতুন খেলোয়াড়ের অসম্ভব কপাল...কিম্বা হাতের কায়দা। ঘুঁটি চাললে সবচেয়ে বেশি নম্বরের ফোঁটা ছাড়া আর কিছু বেরোয় না তার হাত থেকে।
প্রীতম সিং-এর জেদ চেপে গেল। বাজি লাগিয়ে খেলা শুরু করল। প্রথমদিন যা হারল, দ্বিতীয় দিন সেটাই ফিরে পাওয়ার জন্যে বাজি লাগাল। দ্বিতীয় দিনে আবার হারল। তৃতীয় দিনে, চতুর্থ দিনে একই গল্প। প্রীতম সিং কী হেরেছিল, কত টাকা হেরেছিল জানি না, কিন্তু পরাজয়ের গ্লানিটা একসময় নিশ্চয় অসহ্য হয়ে উঠেছিল। অতএব পঞ্চম দিনে প্রীতম সিং-এর ধৈর্যচ্যূতি ঘটল। সেই নতুন জুয়াড়ির মুন্ডুটা এক কোপে নামিয়ে দিয়ে খেলা শেষ করল প্রীতম সিং।
বলেন কী! তারপর?
লোকে বলে, ওই গুম খুন হওয়া মানুষটার অভিশাপেই দু-বছরের মধ্যে প্রীতমপুর ছারখার হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে প্রীতম সিং মারা গেল। তারপর এল গুটিবসন্তের মহামারি। যে-ক'টা লোক শহরে অবশিষ্ট ছিল তাদের মধ্যেও অর্ধেক সাবাড় হয়ে গেল পরের বর্ষায় ভাগীরথীর বন্যায়। বাকিরা শহর ছেড়ে পালাল। তখন থেকেই প্রীতমপুর এক পরিত্যক্ত শহর। আসবার পথে দেখলেন তো নিশ্চয় মহাল প্রীতমপুরের ধ্বংসাবশেষ?
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে জ্ঞানাতীত ভটচাজ বোধহয় পাপের পরিণামের কথাই ভাবলেন। তারপর আবার শুরু করলেন—
জানেন বোধহয়, যে কোনো জমিদারি লাটে ওঠার পরে শেষ অবধি যা থেকে যায়, তা হল দেবোত্তর সম্পত্তি। এখানেও তাই রয়েছে। এই মন্দির, আমার ঘর আর সামান্য পুকুর বাগান ধানজমি দেবী মুক্তকেশীর নামে দেবোত্তর করা আছে। কোনো রকমে পুরোহিতের বেতন আর দেবীর নিত্যপূজার খরচটা উঠে যায়।
আর মন্দিরের ভেতরে ওই সিন্দুকটার মধ্যে রয়েছে দেবীর কিছু অলঙ্কার, একটা দক্ষ্মিণাবর্ত শঙ্খ, পঞ্চমুখি রুদ্রাক্ষ আর ওই পাশার ছক। পাশার ছকটা কেন যে মন্দিরে রাখা আছে তা আমি জানি না। তবে এটা জানি, ওই পাশাকে মন্দির থেকে বার করলে ওটা আর থাকবে না। আমি গত দু-বছর ধরে দিনরাত অনুভব করি, কেউ একজন ওই পাশাটাকে হাতে পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সে মানুষ নয়।
এইখানে অপূর্ব একটু শব্দ করে হেসে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে তার উল্টোদিকে বসে থাকা প্রৌঢ় কথকের চোখ দুটো জ্বলে উঠল। —হাসছেন? আপনি জানেন, আমার আগে যিনি পুরোহিত ছিলেন তাঁর মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল? ওই মন্দিরের দরজায় তাঁর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। কোমর থেকে পা অবধি বাইরে, বাকি অর্ধেক ভেতরে। এক হাতে আঁকড়ে ধরেছিলেন এই পাশা, আরেক হাতে দরজার চৌকাঠ। প্রবল টানে তাঁর কাঁধের হাড় খুলে গিয়েছিল, তবু মুঠো খোলেননি। সেবারে সে বিফল হয়ে ফিরে গিয়েছিল।
কে বিফল হয়ে ফিরেছিল?
জানি না। জানলে তো আমার বউটাও মরত না। জানেন, সে কীভাবে মরেছিল?
নির্বাক অপূর্ব ঘাড় নাড়ল।
একটু আগে মন্দিরের ভেতরে যে লোহার সিন্দুকটা দেখলেন, সেটার গায়ে কপাল ঠুকে। আমরা ভোরবেলায় যখন মৃতদেহটা পাই তখন তার নাকমুখ সব রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার আগেও বহুবার সে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে ওখানে ছুটে গেছে, আর আমি তাকে ধরতে গেলে আমার পায়ে আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে বলেছে—ওগো ওটা আমাকে দাও, আমাকে দাও। নাহলে ও আমাকে ছাড়বে না।
কে ছাড়বে না? অপূর্ব জিগ্যেস করল।
আমিও তো রক্তিমার মাকে সেই কথাই জিগ্যেস করতাম—কে ছাড়বে না? তখন আর কিছু বলতে পারত না। ফ্যাল ফ্যাল করে মুখের দিকে চেয়ে থাকত।
বলেন কী!
আজ্ঞে হ্যাঁ। সেইজন্যেই বলছি, আমার অন্নদাতার জিনিস বিক্রি করে আমি নেমকহারামি করব না। কিন্তু ওটাকে এখান থেকে বিদায় করব। ঈশ্বরেরও তাই ইচ্ছা, নাহলে তিনি আপনাকে এখানে পাঠাবেন কেন? নিয়ে যান, ও পাশা আপনি কালকেই নিয়ে যান।
আনন্দে উত্তেজনায় ঘুম আসছিল না অপূর্বর। একজনের অহেতুক আতঙ্ক যে আরেকজনের এতটা উপকার করতে পারে এ তার ধারণা ছিল না। বউয়ের হিস্টিরিয়ার দৃশ্য দেখে পুরোহিতমশাই জিনিসটা তাকে এমনি এমনি দিয়ে দিলেন! ভাবা যায়? মানে পঞ্চাশহাজার টাকার পুরোটাই তার পকেটে!
ঘুম আসছিল না আরো একটা কারণে। সিনেমা জগতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে নারীসঙ্গ ছাড়া ঘুমোনোর অভ্যেসটাই চলে গেছে অপূর্ব ব্যানার্জির। নারী বলতে, কলকাতায় বা মুম্বইয়ে থাকলে, স্টুডিয়োর দরজায় অপেক্ষারতা অজস্র মেয়েদের মধ্যে যেটিকে পছন্দ হয়। আর অন্য শহরে এসকর্ট-সার্ভিসের রুম-ডেলিভারি।
কিন্তু এখানে, এই অজ পাড়াগাঁয়ে কী হবে?
এখানে রাতটাকে যে মধুময় করে তুলতে পারে সে ওই যে দাওয়ায় বসে আছে। বিছানার পাশের জানলা দিয়েই তাকে দেখতে পাচ্ছে অপূর্ব। দেখতে পাচ্ছে তার সরু কোমর, ভারী নিতম্ব, ভরাট বুকের কিছুটা। হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বসে আছে রক্তিমা।
পাশার বোর্ডে আঁকা নায়িকাদের ছবিগুলো অপূর্বর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ঘুরতে লাগল।
আচ্ছা, রক্তিমাই বা ঘুমোয়নি কেন? ও-ও কি কামার্ত? হতেই পারে। অপূর্ব যুবক, অপূর্ব সুদেহী। এই পাণ্ডব-বর্জিত জায়গায় এরকম সঙ্গী আগে কখনো পেয়েছে রক্তিমা?
বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে দাওয়ায় বেরোল অপূর্ব। কিন্তু বেরিয়ে এসে আর কাউকে দেখতে পেল না। এইটুকু সময়ের মধ্যে রক্তিমা কেমন করে নিজের ঘরে ফিরে গেল?
আর কিছু করার নেই। ওই ঘরেই জ্ঞানাতীতবাবুও ঘুমোচ্ছেন। ব্যর্থ মনোরথ অপূর্ব আবার নিজের বিছানায় ফিরে গেল এবং বেশ কিছুক্ষণ ছটফট করে ভোরের দিকে ঘুমিয়েও পড়ল।
ঠিক ঘুমটা আসার আগে তার হালকাভাবে মনে পড়ল, রক্তিমা খুব সেজেছিল। এত রাতে অত সেজেগুজে কেউ নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসে থাকে? কানে কানপাশা, বাহুতে মান্তাসা, কোমরে রুপোর গোঠ, বিনুনিতে জুঁইফুলের মালা।
অপূর্ব নিজের মনেই ভাবল, ধুর, স্বপ্ন দেখছি। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন ভোর থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। আবার কোথাও একটা অকাল-সাইক্লোন তৈরি হয়েছে নিশ্চয়।
অপূর্ব একদমই রাজি ছিল না, তবু জ্ঞানাতীতবাবু কিছুতেই শুনলেন না। একটু ডাল-ভাত না খাইয়ে তিনি অপূর্বকে এতটা দূরের পথে কিছুতেই ছাড়বেন না। অগত্যা অপূর্ব স্নান করে তৈরি হতে লাগল। জ্ঞানাতীতবাবু মন্দিরে সকালের পুজো করতে চললেন। যাবার সময় বলে গেলেন, আপনি খাওয়াদাওয়া করে ওখানেই চলে আসুন। জিনিসটা নিয়ে একেবারে রওনা দেবেন।
জ্ঞানাতীতবাবু বেরিয়ে যাবার পরে অপূর্ব ফাঁকা বাড়িতে রক্তিমাকে কুপ্রস্তাবটা দিয়েই ফেলল। বদলে সিনেমায় চান্স করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি।
পাথরের মতন কঠিন মুখে তার সামনে ভাতের থালা সাজিয়ে দিয়ে রক্তিমা বলল, যত তাড়াতাড়ি পারেন খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যান। বাবা পুরুষমানুষ, তাই বুঝতে পারেননি। আমি কাল থেকেই আপনার চোখে হ্যাংলামি দেখছি। নেহাত অতিথি, তাই...।
এরপরে আর ওই মেয়ের সামনে বসে খাওয়া যায়? কোনোরকমে নাকে মুখে দুটো গুঁজে অপূর্ব মন্দিরের চাতালে গিয়ে উঠল। কি ভেবে কপালে হাত জড়ো করে মা-কে একটা প্রণামও করে ফেলল। জ্ঞানাতীতবাবু পাশার বোর্ডটা অপূর্বর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, সাবধানে যাবেন।
অপূর্ব সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছিল। হঠাৎ-ই পেছন থেকে জ্ঞানাতীতবাবু ডাকলেন, এক মিনিট দাঁড়িয়ে যান তো ভাই।
অপূর্ব ঘুরে দাঁড়াল। জ্ঞানাতীত ভটচাজ এসে তার হাতে একটা ছোট মোড়ক ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা পকেটে রেখে দিন। মায়ের নির্মাল্য, সবরকম বিপদ থেকে আপনাকে বাঁচাবে। আচ্ছা, আর দেরি করবেন না। যত তাড়াতাড়ি প্রীতমপুর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারেন, ততই মঙ্গল।
রাস্তার বাঁক ঘুরতেই গাড়ির রিয়ার-ভিউ-মিরর থেকে হারিয়ে গেল মুক্তকেশীর মন্দির আর প্রীতমপুর রাজবাড়ি। কিন্তু সামনে যে দৃশ্য অপেক্ষা করছিল তার জন্যে অপূর্ব একেবারেই মানসিকভাবে তৈরি ছিল না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল রক্তিমা। পরনে একটা সাদামাটা ডুরে শাড়ি। মাথায় একটা ছাতা পর্যন্ত নেয়নি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটা ভিজছে।
ও কখন থেকে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে? রক্তিমার সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে হাত বাড়িয়ে জানলার কাচ নামাল অপূর্ব। জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার?
অত্যন্ত মোহন ভঙ্গীতে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে রক্তিমা বলল, তুমি যা চেয়েছিলে তাতে আমি রাজি।
অপূর্ব গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল। ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। কিন্তু অপূর্ব একেবারেই তা টের পাচ্ছিল না। সে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল রক্তিমাকে। এই মেঘলা আলোয় ওকে অলৌকিক সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখের মণিদুটো দিঘির মতন অতল। কপালে ভিজে চুলের গুছি লেপটে আছে। চিবুক থেকে ঝরা জল গলার ত্রিবলি ছুঁয়ে বুকের গভীর বিভাজিকার ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছে। আদুল পেটের টানটান চামড়া বেয়ে পিছলে নামছে জলের ফোঁটা।
হঠাৎ মত পরিবর্তন?—জিগ্যেস না করে পারল না অপূর্ব।
খিল খিল করে হেসে উঠল রক্তিমা। বলল, তখন ছেনালি করছিলাম গো, ছেনালি। বাড়ির ভেতরে ওসব করতে ভয় লাগবে না? কখন কে চলে আসে তার ঠিক নেই। চলো না ওখানে, সব বলছি।
রক্তিমা হাতের ইঙ্গিতে যেদিকে দেখাল, সেদিকে প্রীতমপুরের অনেক পোড়ো বাড়ির মধ্যে একটা দাঁড়িয়ে আছে। সম্মোহিত অপূর্ব তখনই রক্তিমার পেছন পেছন সেদিকে রওনা দিচ্ছিল। রক্তিমাই ভ্রুভঙ্গি করে তাকে থামাল। বলল, ঘটে কি একটুও বুদ্ধি নেই? গাড়িটা এভাবে রাস্তার ওপর পড়ে থাকলে লোকজন খোঁজ নেবে না?
মনে মনে জিভ কেটে অপূর্ব গাড়িটাকে রাস্তা থেকে পাশের ঢালে নামিয়ে একটা করমচা ঝোপের আড়ালে পার্ক করাল। রক্তিমা কাছেই দাঁড়িয়েছিল। অপূর্ব দরজাটা লক করতে যেতেই সে বলল, ওটা নিয়ে এসো।
কোনটা? অবাক গলায় জিগ্যেস করল অপূর্ব।
পাশাটা। নিয়ে এসো, তারপর বলছি কেন।
প্রায় অন্ধকার ঘরটায় ঢুকেই রক্তিমা অপূর্বর গলায় হাতের বেড় দিয়ে জড়িয়ে ধরল। অপূর্বর চোখের সামনে আবার পাশার ছকের ছবিগুলো নেচে উঠল। রক্তিমা মুখ তুলে অপূর্বর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, আমরা এবার পাশা খেলব, কেমন?
জিতলে আমি তোমার।
আর হারলে ওই পাশা আমাকে দিয়ে যাবে, ঠিক আছে?
রক্তিমার নিশ্বাসে কি মাদকতাময় গন্ধ! অপূর্বর মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল। সে শুধু বলতে পারল, কিন্তু আমি যে খেলতে জানি না।
চলো না শিখিয়ে দিচ্ছি। খুব সহজ খেলা। অপূর্ব খেয়াল করল না যে, সে ধুলোয় ভরা মেঝের ওপরেই বসে পড়েছে। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছিল, রক্তিমার ভারী উরু তার উরুর ওপরে চাপ দিচ্ছে। রক্তিমা পাশে বসে তাকে পাশা খেলার প্রথম পাঠ দিল। প্রথমবার ছকের ওপর ঘুঁটি চালল অপূর্ব।
ঘুঁটি চালল রক্তিমাও। রক্তিমার জিত। আবার ছক সাজাল রক্তিমা। তারপর ফিসফিস করে বলল, আমাকে তুমি হারাতে পারবে না।
কেন?—জিগ্যেস করল অপূর্ব।
এ আমার হাতের পাশা। এই পাশায় আমাকে কখনো হারানো যায়?
অপূর্বর মাথার মধ্যে সম্মোহনের ঘোর ক্রমশ বেড়ে উঠছিল। সে দেখল রক্তিমার কানে কানপাশা, গলায় সাতনরী, কোমরে রুপোর গোঠ। রক্তিমার বিনুনিতে জুঁইফুলের গোড়ে মালা জড়ানো। রক্তিমার ঠোঁট পানের পিকে লাল হয়ে আছে। রক্তিমা যেন আর রক্তিমা নেই।
অপূর্ব আবার ঘুঁটি চালল। রক্তিমাও। এবারও রক্তিমার জিত।
অপূর্ব দেখল রক্তিমা বাঁ-হাতে দান দিল। সে বলল, বাঁ-হাতে দান দিলে যে?
খিলখিল করে হেসে উঠল রক্তিমা। বলল, ডান হাতটা প্রীতমবাবু কেটে নিলেন যে। আমার খেলা দেখে ওনার মনে হয়েছিল আমার হাতে যাদু আছে। তাই আমার ডান হাতটা কেটে নিলেন।
ঘুঁটি চালতে চালতে খুব স্বাভাবিক স্বরে অপূর্ব বলল, তবে যে পুরোহিতমশাই বললেন, কোন এক কর্মচারী মরেছিল। তার না কি মুন্ডু কেটে নিয়েছিল।
কর্মচারী বলে ভুল কী করল? আমি ছিলাম প্রীতমবাবুর বাঁধা রাঁঢ়। মোহরে মাইনে পেতাম। তবে হ্যাঁ, মুন্ডু কাটার কথাটা মিনসে ঠিক বলেনি। মুন্ডু কাটলে কম কষ্ট পেয়ে মরতাম। প্রীতমবাবু একদম কাঁধ থেকে আমার ডান হাতটা কেটে নিয়েছিল।
কেন? হাত কেটে নিল কেন?—সম্মোহিত অপূর্বর গলায় অবিকল কোনো রূপকথা-মুগ্ধ শিশুর সারল্য।
ওই যে বললাম। আমার খেলা দেখে বাবুর মনে হল, আমার হাতে তুক আছে। তাই হাতটা কেটে নিয়ে লালবাগের হাতির দাঁতের কারিগর হেমন্ত সর্দারকে দিয়ে বলল, যা, এটা দিয়ে এক সেট পাশা বানিয়ে দে। বাবু ভেবেছিল, ওই পাশা নিয়ে খেললে কেউ তাকে হারাতে পারবে না।
অপূর্ব ঘুঁটি চালল। বজ্রপাতের খুব ক্ষীণ আওয়াজ তার চেতনায় একটুখানি ঢুকে আবার হারিয়ে গেল। সে শুধু একবার মুখ তুলে দেখল রক্তিমার, কিম্বা রক্তিমার মতন দেখতে সেই মেয়েটার, ডান কাঁধের কাছটায় মাংস ডেলা পাকিয়ে রয়েছে।
মেয়েটা ছকের ওপর নিজের দান ফেলে মুখ তুলে বলল, তা হেমন্ত সেই পাশা বানিয়েও দিল। দেখছ তো কত সুন্দর বানিয়েছে। ওই যে, কামকেলির ছবি আঁকা ছকটা—ওটা বানিয়েছে আমার সেই হাতের চামড়া দিয়ে। আর ঘুঁটিগুলো...ঘুঁটিগুলো কী দিয়ে বানিয়েছে বলো তো?
অপূর্ব আনমনে বলল, তোমার হাতের হাড় দিয়ে।
ঠিক বলেছো। কিন্তু এবারেও যে তুমি হারলে নাগর। তাহলে এই পাশা আমি নিয়ে যাই? নিজের একটা ছিন্ন অঙ্গ ফেলে রেখে কতকাল ঘুরে বেড়ানো যায় বলো। আমি তো আর সতী ছিলাম না।
ও নাগর, তোমার আপিত্য নেই তো?
অচৈতন্য অপূর্ব মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়েছিল। আপত্তি থাকলেও তা প্রকাশ করবার মতন অবস্থা তখন তার ছিল না।
Comments
Post a Comment