ছাদের বাগান - ঈশ্বরের নষ্ট ভ্রূণ - সৈকত মুখোপাধ্যায়


ছাদের বাগান

সৈকত মুখোপাধ্যায়


 আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, অসিতদাকে আমার সমস্যাটার কথা বলব। কখন বলব সেটাও ভাবা ছিল। যখন ডায়না বার থেকে মাল খেয়ে বেরিয়ে আমরা দুজন টানা রিকশায় চেপে শিয়ালদা ফিরব, তখন। 

অসিতদা পণ্ডিত লোক। ন্যালাখ্যাপা পণ্ডিত নয়, বেশ গোছালো পণ্ডিত। কলেজের প্রফেসর। ইংরিজি কাগজে কলাম লেখে। ঘ্যাম-ই আলাদা। ধবধবে সাদা লিনেনের শার্ট আর গাঢ় নীল কর্ডের ট্রাউজারস ছাড়া কোনোদিন কিছু পরতে দেখিনি। চোখে সোনালি ডাঁটির রিমলেস চশমা। বরাবর দেখেছি, ডায়না থেকে মাল খেয়ে বেরোনোর সময় টেবিল থেকে হাতে একটা পেপার-ন্যাপকিন তুলে নিতে ভোলে না। এসির ঠান্ডা থেকে বেরোলে চশমার কাচে ভেপার জমে যায় তো, সেটা ওই ন্যাপকিন দিয়ে মুছে তবে রাস্তা পেরোবে। চার পেগ ভোদকা মারবার পরেও যার মাথা এত ঠান্ডা থাকে, তার ওপর আস্থা রাখাই যায়।

এইজন্যেই ঠিক করেছিলাম, ওকেই আমার প্রবলেমের কথা বলব। তাছাড়া আমার আর জয়িতার অবৈধ প্রেমের গল্পটা ও একটা ধারাবাহিক উপন্যাসের মতন প্রতি মাসের প্রথম শনিবারে পড়ে আসছে, মানে শুনে আসছে। ওই একটা দিনই আমরা দুজন ডায়নায় মিট করি এবং প্রথম গ্লাসটা শেষ হবার আগেই আমি জয়িতাকীর্তন শুরু করে দিই। অসিতদা কিছু মাইন্ড করে না। সাইকোলজির অধ্যাপক, সম্ভবত আমাকেও একটা কেস-স্টাডি হিসেবেই দেখে। 

ডায়না বার থেকে বেরিয়ে, চাঁদনির মুখ থেকে টানা-রিকশায় উঠেছিলাম। সেই রিকশা গনেশ অ্যাভিনিউ ক্রশ করে অতীতকালে ঢুকে পড়ল। শুধু এই অতীত ভ্রমণটুকুর লোভেই ট্যাক্সির বদলে রিকশা চেপে আমরা শিয়ালদা ফিরি। আমাদের চোখে কলকাতার সমস্ত কড়া আলো ততক্ষণে অ্যালকোহলের প্রভাবে স্তিমিত হয়ে এসেছে, সমস্ত চিৎকারকেই মনে হচ্ছে গুঞ্জরণ। তিন হাত চওড়া গলিপথ ধরে টুঙ টুঙ ঘণ্টি বাজিয়ে আমাদের টাইম-মেশিন এগিয়ে চলেছিল। গলির দুপাশে ভেজা ভেজা নীল দেয়ালের বাড়ি, বাড়ির দোতলায় ঝুলবারান্দা। ঝুলবারান্দার রট-আয়রনের রেলিং-এ জটিল লতাপাতার নকশা, রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি, আতাগাছে তোতাপাখি। বাড়িগুলোর একতলায় ঘুপচি ঘরের কোনোটায় দুর্গাপ্রদীপ জ্বেলে স্যাঁকরা ফুঁনলে ফুঁ মারছে, কোনোটায় দপ্তরী তুঁতের আঠায় বই বাঁধাচ্ছে। পুরো পথটায় ময়লা বাল্ব ঝোলানো কয়েকটা মুদিখানা আর পাথুরে কয়লার ডিপো ছাড়া অন্য কোনো দোকান নেই —না সিম কার্ড, না রোল পরোটা। কোথাও এমন কিচ্ছুটি নেই যা একশো বছর আগেও ছিল না। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, হুজুরিমল লেন টেন, আরো কীসব সরু সরু রাস্তা ধরে নেবুতলা পার্কে পৌঁছোনো অবধি আমাদের গতজন্মে ফিরে যাওয়ার এই ইলিউশন বজায় থাকবে। এই একটা সময়, যখন চেতন অবচেতনের পার্থক্য ঘুচে যায়, কোনো কথাকেই গর্হিত মনে হয় না, কোনো কাজকেই অসম্ভব লাগে না। অসিতদাকে বলবার জন্যে এই সময়টাকেই বেছে নিয়েছিলাম।

বললাম, অসিতদা, মালটাকে মার্ডার করতে হবে। তাছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না?

অসিতদা শান্তগলায় প্রশ্ন করল, কাকে, সোমনাথকে?

বললাম, তাছাড়া আর কাকে?

অসিতদা ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যেও একটা মাত্র কাঠি খরচা করে আমাদের দুজনের সিগারেটই ধরিয়ে ফেলল। হাত কাঁপাকাঁপির কোনো গল্পই নেই।

এইজন্যেই অসিতদাকে এত ভালো লাগে। কোনোকিছুই ওর কাছে অকল্পনীয় নয়। অনৈতিক তো নয়ই। খাঁটি অ্যাকাডেমিশিয়ান যাকে বলে। ও শুধু চায়, যা ঘটবে তা যেন পরিচ্ছন্নভাবে ঘটে। কেউ যদি কাউকে খুন করতে চায় করুক। তবে সাদা শার্টের হাতায় যেন রক্তের দাগ না লাগে। ওর কাছে 'কী করা হচ্ছে' তার থেকেও বড় কথা হল 'কীভাবে করা হচ্ছে'। তাই অসিতদার পরের প্রশ্নটার জন্যে আমি মনে মনে তৈরিই ছিলাম। 

সোমনাথকে কীভাবে সরাবি তার কোনো উপায় ভেবেছিস?

আমি বললাম, সুপারি কিলার লাগালে কীরকম হয়?

অসিতদা ব্যাঁকা হেসে আমাকে একবার আড়চোখে মাপল। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, মনে মনে বলল, ইডিয়ট। মুখে বলল, জয়িতা তোমার দিকে অনেকটা হেলে রয়েছে ঠিকই। কিন্তু এটাও জেনে রাখো, খুনখারাপি হলে জয়িতা সে চাপ নিতে পারবে না। ভয়ের চোটে পুলিসের কাছে তোমার নাম ফাঁস করে দেবে। 

আমি অসিতদার হাত চেপে ধরলাম। বললাম, কিন্তু অসিতদা, শুয়োরের বাচ্চাটা জয়িতার চোখের সামনে যতক্ষণ ঘুরে ফিরে বেড়াবে, ততক্ষণ জয়িতা কিছুতেই আমাকে পুরোপুরি অ্যাকসেপ্ট করতে পারবে না। এ কথা জয়ী নিজেই আমাকে বলেছে। সোমনাথ ভবঘুরে হতে পারে, বেকার হতে পারে, পাতাখোর হতে পারে কিন্তু তবু ও জয়িতাকে জীবনে প্রথম চুম্বনের স্বাদ দিয়েছিল। ও যতক্ষণ পৃথিবীতে থাকবে জয়িতা কিছুতেই পুরোপুরি আমার হতে পারবে না।

অসিতদা বলল, 'পুরোপুরি আমার' কথাটা ঠিক বুঝলাম না অবশ্য। কোনো মানুষ আজ অবধি মনের দিক থেকে পুরোপুরি অন্য এক মানুষের হয়েছে বলে জানি না। সম্ভবত তুই শরীরের কথা ভাবছিস, ইন্টারকোর্সের কথা ভাবছিস। 

মাথায় ভরপুর নেশা নিয়ে যতটা অপমানিত বোধ করা যায়, অসিতদার এই কথায় ততটাই অপমানিত বোধ করলাম। বললাম, দিস ইজ আনফেয়ার অসিতদা। তুমি ভালোই জানো, আমি জয়িতাকে বিয়ের কথা ভাবছি। সেটা তো সোমনাথ না মরলে সম্ভব নয়। 

অ!

অসিতদা, শিয়ালদায় তো ঢুকে গেলাম। একটা রাস্তা বাতলে দিয়ে যাও। 

তুই এক কাজ কর নীলাদ্রি, তুই সোমনাথকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দে। ইনস্টিগেট হিম টু কমিট সুইসাইড। এতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। মানে বুঝলি তো? এমন কিছু কর যাতে সোমনাথ সুইসাইড করে। 

নৈহাটি লোকালের সময় হয়ে গিয়েছিল। অসিতদা রিকশার ভাড়া মিটিয়ে স্মার্টলি প্লাটফর্মের দিকে পা চালাল। আমি পেছন পেছন দৌড়ে গিয়ে ওর কনুই চেপে ধরলাম। বললাম, প্ররোচনাটা কী ধরনের হতে পারে সেটা তো বলো। ওকে চড়-থাপ্পড় মারতে গেলে জয়িতাই আমাকে বাধা দেবে।

অসিতদা এবারে সত্যিকারে বিরক্ত হয়ে বলল, রিয়েলি নীলাদ্রি, তুই এত ত্রু«ড ওয়েতে সবকিছু ভাবিস কেন বল তো? সুপারি কিলার! চড়-থাপ্পড়! বুলশিটস! কেন, ওকে একটা ছাদের বাগান করতে বলতে পারছিস না? 

একটা অটো পেছন থেকে আমার দু-পায়ের ফাঁকে চাকাটা গলিয়ে দিয়ে তারস্বরে হর্ন বাজাচ্ছিল, তবু আমার সম্বিত ফিরতে ঝাড়া দেড় মিনিট সময় লাগল। 

রাস্তার একপাশে সরে গিয়ে দেখলাম অসিতদা ততক্ষণে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছে। 

ছাদের বাগান! আত্মহত্যার প্ররোচনা! বিড়বিড় করতে করতে আমি কখন যেন বি আর সিং-এর পাঁচিলের গায়ে সারি সারি ফুলের নার্সারিগুলোর মধ্যে একটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। অবাক হয়ে শুনলাম, অন্য কেউ নয়, আমি নিজেই দোকানিকে জিগ্যেস করছি—একটা ছাদের বাগান করতে গেলে কী-কী লাগে ভাই? 



এবার বোধহয় কে জয়িতা, কে সোমনাথ এসব একটু বলে নেওয়া দরকার। জয়িতা তেমন কেউ নয়, একটা এলেবেলে মেয়ে। সোমনাথ আরও এলেবেলে একটা ছেলে। বছর পাঁচেক আগে জয়িতা যখন সোমনাথকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, তখনও সে একটু-আধটু মানুষের মতন ছিল। কবিতা-টবিতা লিখত। উস্কোখুস্কো চুল, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা, মায়াবী চোখ। কথার মধ্যে দু-চারটে প্রেমের কবিতার লাইন গুঁজে দিতে পারত। তার ওপরে ভালো বাউলগান গাইত। যুগে যুগেই বোকা মেয়েরা এ ধরনের ছেলেদের প্রেমে পড়েছে এবং পরে পস্তিয়েছে। এর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। নতুনত্ব রয়েছে পাঁচবছরের মধ্যে জয়িতার দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়ায়। 

এবার জয়িতা তার ভাড়াটের প্রেমে পড়ল, মানে আমার। 

বছর দেড়েক আগে আমি ওদের গুলাম আলি রোডের জরাজীর্ণ বাড়িটায় ভাড়াটে হয়ে ঢুকেছিলাম। তার আগে অবধি সোমনাথ কোনো এক পাবলিশারের ঘরে প্রূফরিডারের কাজ করত। গাঁজা চরসের ধোঁয়ায় বুদ্ধিবৃত্তি ঝাপসা হয়ে যাওয়ার ফলে এক নামজাদা ঔপন্যাসিকের পান্ডুলিপির এমন হাল করে ছেড়েছিল যে, সেই বাস্তববাদী উপন্যাস আগাপাস্তলা ভাববাদী হয়ে গিয়েছিল। এরপরে আর ওকে কাজ করতে দেওয়া পাবলিশারের পক্ষে নিরাপদ মনে হয়নি। অগত্যা দুবেলা দুমুঠো ভাতের পয়সা জোগাড় করতেই জয়িতা ওদের ছাদের ঘরটা আমাকে ভাড়া দিয়েছিল।

আমি সল্টলেকে একটা আই টি কোম্পানিতে চাকরি করি। অনেক সময়েই নাইট ডিউটি থাকে। তখন সারাদিন ছাদের ঘরে বসে এটা ওটা পড়ি। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি কলকাতার শেষ কয়েকটা আমগাছের মধ্যে একটার ডালে বিলুপ্তপ্রায় দুটো গাংশালিক বাসা বাঁধছে। আমি নেট সার্চ করি না, আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, মোবাইলে বেশি কথা বলি না। আসলে আমার জীবন থেকে একটা মেয়ে কোনো চিহ্ন না রেখে হারিয়ে গিয়েছিল। তাই আমি জানতাম, এই সব তথ্যের স্রোত টোত খুব ফালতু ব্যাপার। জীবনে যারা সত্যিকারে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সঙ্গে হাজার মোবাইলেও কোনো কথা বলা যায় না। লক্ষ ফেসবুক প্রোফাইল ঘাটলেও তাদের মুখ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই আমি নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম আর মাসে একটা শনিবার আমার উত্তরবঙ্গের দেশের প্রতিবেশী অসিতদার সঙ্গে আড্ডা মারতাম। 

বুঝতে পারতাম জয়িতা আমার দিকে নজর রাখছে। বুঝতে পারতাম আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে জয়িতা ব্যস্ততার ভান করছে। আসলে ওর কিছু করার নেই। ও-ও আমারই মতন একা, উপরন্তু কর্মহীন।

আলাপ হওয়ার পর বুঝতে পারলাম জয়িতা ব্যাপক রোমান্টিক মনের মেয়ে। যে মেয়ে ব্যর্থ কবিকে ভালোবেসে নৌকা পুড়িয়ে দিতে পারে সে যে রোমান্টিক হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। বুঝতে পারতাম ভালোবাসা জমে জমে ওর হৃদয় মৃতবৎসা গাভীর বাঁটের মতন টনটন করছে, ও ভালোবাসার দুধ ঝরাতে পারছে না।

কারণ হারামজাদা সোমনাথ বাড়িতে থাকে না। 

চামড়ার বাছুরের ভূমিকায় নামতে আমার ঘোর আপত্তি ছিল। আমি প্রথম প্রথম জয়িতাকে অনেক বুঝিয়েছিলাম। বলেছিলাম—দ্যাখো এই সব পরিণতিহীন সম্পর্ক শুধু দুঃখই দেয়। 

কিসের পরিণতিহীন? ফোঁস করে উঠেছিল জয়িতা। মেরে ফেলো না জানোয়ারটাকে। মেরে ফেল ওকে। আমি মুক্তি পাই তাহলে।

অতঃপর জয়িতা আমার মুখটা ওর সুগন্ধী দুই স্তনের মাঝখানে টেনে নিয়েছিল। 

জয়িতার ক্ষুধার্ত শরীরের মধ্যে ডুবতে ডুবতেও আমি ভাবছিলাম— অপ্রেমের শূন্যতা শরীর কখনো পূরণ করতে পারে না। কোনোদিনও পারেনি। বোধহয় সেই শূন্যতাকে ভরাবার জন্যেই আমি জয়িতাকে জীবনপণ করে ভালোবেসে ফেললাম। 

বুঝতে পারতাম জয়িতাও আমাকে ভালোবাসবার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটা বছর পঁয়ত্রিশের নোংরা ছেলে। ভবঘুরে, বেকার, পাতাখোর। অনেকদিন বাদে-বাদে যে একবার করে উদয় হয়ে জয়িতাকে বলে, খেতে দাও। ভাত ছাড়া সে জয়িতার কাছে আজকাল আর কিছুই চায় না। 

তবু তার জন্যেই জয়িতা এখনো হাতের চুড়িতে একটা সেফটিপিন লাগিয়ে রাখে। সেফটিপিন মানে লোহা, যে লোহার ছোঁয়ায় আমার প্রেতশরীর জয়িতার আলিঙ্গনের মধ্যেই হঠাৎ নির্জীব হয়ে পড়ে। 

সেইজন্যেই এখন দিনরাত মনে পড়ে জয়িতার ওই কথাগুলো —মেরে ফেলো না জানোয়ারটাকে। আমি মুক্তি পাই।

আমাদের দুজনের মুক্তিই নির্ভর করছে সোমনাথের মৃত্যুর ওপরে। আর সোমনাথের মৃত্যু লুকিয়ে আছে ছাদের বাগানে।



সন্ধেবেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিসের বাস ধরবার জন্যে বড় রাস্তার দিকে হাঁটছিলাম। দরজার ঠিক বাইরেই সোমনাথের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখে প্রথমে একটু থতমত খেলেও শালা পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। একগাল হেসে বলল, এই যে নীলাদ্রি, একশোটা টাকা হবে? খুচরো নিয়ে এমন প্রবলেমে পড়েছি। পাঁচশো টাকার নোট কেউ ভাঙাতে চাইছে না। কালই তোমাকে ফেরত দিয়ে দেব।

খুব খুশি হলাম। ফাঁদ সাজিয়ে রাখার পরে শিকারি যখন দেখে শিকার সেই ফাঁদের দিকে এগোচ্ছে, তখন সে যেমন খুশি হয়, তেমনি খুশি। তিনদিন হয়ে গেল টব-ফব, মাটি-টাটি কিনে ছাদে ডাঁই করে রেখেছি, কিন্তু যার জন্যে এত আয়োজন তারই দেখা নেই। আমি সোমনাথের হাতটা চেপে ধরে বললাম, কেন দেব না ভাই, নিশ্চয়ই দেব। তবে এখন নয়। 

এখন নয়? কেন?—সোমনাথের মুখচোখ হিংস্র হয়ে উঠল।

ঘাবড়ালাম না। ঘাবড়ালে চলবে না। গম্ভীরভাবে বললাম, একশোর অনেক বেশিই দেব। তবে তার জন্যে আমার ছাদের বাগানের দেখাশোনার ভারটা তোমাকে নিতে হবে। 

টাকার কথায় সোমনাথ বেশ উৎসাহ পেল। সুর করে বলল, আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর। চলো, কোথায় কী করতে হবে দেখিয়ে দাও। 

সেদিন আর অফিস যাওয়া হল না। সোমনাথকে নিয়ে ছাদে উঠলাম। ব্যাটাচ্ছেলে মাটি নিয়ে খানিক ঘাঁটাঘাঁটি করে উঠে পড়ল। বলল, দাও, এবার টাকা দাও। 

দিলাম টাকা। বাগান করাটা তো আমার উদ্দেশ্য নয়। ওকে ক্রমশ এই ছাদের বাগানের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলাটাই একমাত্র কাজ।

তাই পরের দিন যখন দেখলাম, ও নিজে থেকেই সন্ধেবেলায় ছাদে উঠে বসে আছে তখন উত্তেজনায় আমার নিশ্বাস দ্রুত পড়তে শুরু করল। অসিতদার প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়লাম। এমনি এমনি সাইকোলজির প্রফেসর হয়? সেদিন সোমনাথ বারোখানা টবে সারমাটি ভরে ফেলল। যাবার আগে আমার কাছ থেকে টাকা নেবার সময় বলে গেল, টব তৈরি। কাল গাছ এনে দিও। 

পরেরদিন ছিল মাসের প্রথম শনিবার। অসিতদাকে অগ্রগতির কথা জানিয়ে বললাম, শিয়ালদা থেকে গাছ কিনে নিয়ে যাব। কী গাছ কিনি বলো তো। 

অসিতদা একটু ভেবে বলল, গাছ কিনিস না। গাছের বালব...বালব বুঝিস তো? কন্দ। কন্দ কেন। তাহলে অনেকটা সময় পাবি। ভুঁইচাঁপার বাল্ব কিনে নিয়ে যা। মাসখানেক জল ঢালার পর মাটি ফুঁড়ে একটু অঙ্কুর মাথা তুলবে। তারও অনেকদিন পরে পাতা ছাড়বে। তারপর ফুল। ফুল হতে হতে সোমনাথ সুইসাইড করবে। তবে তা যদি না হয়...।

কী না হয় সোমনাথদা? উদ্বিগ্নমুখে জিগ্যেস করলাম। 

মানে কোনো কারণে যদি সোমনাথ মরার আগেই ফুল ফুটে যায়...। 

কী হবে তাহলে?

নাঃ, তার চান্স নেই। যার চান্স নেই তা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই ভুঁইচাঁপাই কিনে নিয়ে যা। 

নিয়ে এলাম ভুঁইচাঁপার কন্দ। টবে টবে সেই কন্দ পুঁতে আলতো হাতে জল দিল সোমনাথ। পরেরদিন দুপুরে আমার আর জয়িতার সঙ্গমের মধ্যে কার যেন শরীরের ছায়া পড়ল। চমকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, জানলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সোমনাথ। তার মুখ ঝুলনের পুতুলের মতন ভাবলেশহীন। এরকমই কী হবার কথা ছিল? শেষ কবে যে সোমনাথ দিনের বেলায় বাড়ি ফিরেছে তা জয়িতাও মনে করতে পারে না। তবু সোমনাথ আজ এসেছে। সে কি বাগানের টানে, না কি মৃত্যুর?

কী জানি। এ সব প্রশ্নের উত্তর শুধু অসিতদাই জানে।

দরজা খুলে যতক্ষণে বাইরে বেরোলাম ততক্ষণে সোমনাথ টবের সারির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার দিকে না তাকিয়েই সোমনাথ বলল, বেশ খানিকটা বিষ এনে দিও তো।

বুকের রক্ত চলকে উঠল। শুকনো গলায় জিগ্যেস করলাম, কেন?

টবের মাটিতে পোকা ঘুরছে। 

মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। অসিতদা হত্যাকেও কি নিপুণ শিল্পরূপ দিতে চলেছে! ঘুঘু প্রফেসর সব জানত—ছাদের বাগানের টানে সোমনাথ দিনের বেলায় বাড়ি ফিরবে, আমাকে আর জয়িতাকে শঙ্খলাগা অবস্থায় আবিষ্কার করবে, তারপর...তারপর সোমনাথের চারিদিকে ছড়ানো থাকবে বিষ...। 

আমি দেরি না করে সেইদিন বিকেলেই বাজারের সেরা যত কীটনাশকের কৌটো কিনে এনে ছাদের চারিদিকে সাজিয়ে রাখলাম। আঃ! এরপর সোমনাথ নেশাতুর চোখে যেদিকেই তাকাবে, দেখবে আড়াআড়ি হাড় আর মড়ার খুলি তাকে আয় আয় বলে ডাকছে। ও কি সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবে?

মাসখানেকের মধ্যে কিছু হল না অবশ্য। মনে মনে ভাবলাম, এ তো সুপারি দিয়ে খুন নয় যে চুলের মুঠিটা ধরল আর চপার দিয়ে গলাটা ফাঁক করে দিল। এ রীতিমতন সাইকো-মার্ডার। এফেক্ট পাওয়ার জন্যে দু-দশ দিন সময় লাগতেই পারে। সুবিধেটা হল, কোনো আফটার এফেক্ট থাকবে না।

যুক্তি যাই বলুক, মনে মনে অধৈর্য্য লাগছিল খুব। সোমনাথকে আরো একটু প্ররোচিত করার জন্যে একদিন বেছে বেছে ওর আসার সময়টাতেই আমার ছাদের ঘরের জানলা হাট করে খুলে রেখে জয়িতাকে একরকম রেপই করলাম। সেদিন ছায়াটা আর জানলার পাশে থমকাল না যে গতিতে আসছিল, সেই গতিতেই জানলা পেরিয়ে ছাদের অন্য প্রান্তে চলে গেল। ধর্ষণ সেরে টলতে টলতে বাইরে এলাম। রাস্তা থেকে একগাদা নেড়িকুকুরের তারস্বর ফোয়ারার মতন ছাদের দিকে উঠে আসছিল। দেখলাম সোমনাথ আলসে থেকে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। আমাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কী কষ্ট যে হয় নীলাদ্রি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে। দেখো, নীচের দিকে তাকাও। শুধুই ভাদুরে কুত্তা, শুধুই ভাদুরে কুত্তা চতুর্দিকে। আর ভিখিরি, মাতাল, চর্মরোগি, বেশ্যা, ঠক, দালাল...। 

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। সোমনাথ বলল, আজকালের মধ্যে খুব ধারালো একটা ছুরি এনে দিতে পারবে? 

আমার গলাটা উত্তেজনায় কেঁপে গেল। বললাম, কী করবে? 

বাঁখারি চাঁছব। চারাগুলো হেলে পড়ছে। বাঁখারি চেঁছে ঠেকনা দিতে হবে। 

শুধু ছুরি নয়, আমি সারা বাজার ঢুঁড়ে যেখানে যত ধারালো অস্ত্র পেলাম সব এনে ছাদের চারিদিকে ছড়িয়ে রাখলাম। পারবে কি সোমনাথ এই প্রলোভন এড়িয়ে যেতে? 

সঙ্গে সঙ্গেই কিছু হল না অবশ্য। শুধু একদিন দেখলাম সোমনাথের কব্জির কাছে একটা ন্যাকড়া জড়ানো রয়েছে। বললাম, কী হয়েছিল? ও বলল, কিছু না। অসাবধানে একটু কেটে গিয়েছিল আর কী।

মনে মনে হাসলাম। সময় হয়ে এসেছে। সোমনাথ আমি দেখেছি, তুমি আজকাল বড্ড বেশি সময় নিয়ে বিষের কৌটো নাড়াচাড়া করো। তুমি নিজের কব্জির ওপর ছুরির ফলাটা ঘষো। তুমি নীচু আলসের ওপর দিয়ে বিপজ্জনকভাবে ঝুঁকে পড়ো। সোমনাথ তুমি জানো না, সমস্ত সৌন্দর্যের আড়ালে এই ছাদের বাগান আসলে কি ভীষণ এক মৃত্যুফাঁদ। পতঙ্গভূক ফুলের মতন এই বাগান তোমার চারদিকে এর মোহন পাপড়িগুলোকে আস্তে আস্তে গুঁটিয়ে আনছে, আর তুমি কীটস্য কীট, নির্জীবের মতন ঘোরাঘুরি করছ এই ছাদের বাগানে। 



ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিন চলে এল। আকাশ এখন কচুরিপানা ফুলের পাপড়ির মতন নীল। সোনালি রোদ সারাদিন ছাদের বাগানে শুয়ে বসে আলসেমি করে, আর সেই রোদ্দুরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় সোমনাথ। কখনো জবা গাছের পাতা থেকে শুঁয়োপোকা ছাড়ায়, কখনো সূর্যমুখীর টবে সার দেয়। অবাক হয়ে ভাবি, এসব ফুলের গাছ ওকে কে কিনে এনে দিল! আমি তো দিইনি। ও নিজে এনেছে! ও কি এই ছাদের বাগানকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছে?

রোববার আমাকে অফিস যেতে হয় না। এই একটা রাত ঘরেই থাকি। সেরকমই এক রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়তে পড়তে দেখলাম, ছাদের মাঝখানে যে ছোট ইটের বেদিটা রয়েছে তার ওপরে চুপ করে বসে আছে সোমনাথ। কী আশ্চর্য! ও কি নেশাভাঙ ছেড়ে দিল? দিনেও বাগান করছে, রাত্তিরেও এখানে বসে আছে! আমি বই মুড়ে রেখে ঘর থেকে বেরোলাম। আস্তে আস্তে সোমনাথের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলাম, কী করছ সোমনাথ? 

সোমনাথ নিমগ্নস্বরে বলল, ছাদ এক আশ্চর্য জিনিস, তাই না নীলাদ্রি? স্বর্গ আর নরকের মধ্যে হাইফেন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তুমি নীচে তাকালে নরক, ওপরে চাইলে স্বর্গ। দ্যাখো, আকাশটা দ্যাখো। 

দেখলাম, কুচকুচে কালো বাতাস কেটে ক'টা সাদা ধবধবে নিশিবক ধীর ছন্দে ডানা নাড়তে নাড়তে উড়ে চলেছে। অনেক দূরের কোনো মন্দির থেকে সন্ধ্যারতির শব্দ ভেসে আসছে। বাতাসেও যেন ধূপধুনোর গন্ধ। না কি ছাদের বাগানে হাসনুহানা ফুটল?

ঘরে ঢুকে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু শোয়াই সার, ফুলের গন্ধে ঘুম আসছিল না। অদৃশ্য ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছিল। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছিল। কেবলই মনে পড়ছিল, সেদিন অসিতদা কি যেন একটা বলতে গিয়েও বলেনি। সোমনাথ মারা যাওয়ার আগে যদি ভুঁইচাঁপার ফুল ফুটে যায় তাহলে কি যেন একটা হবে?

এক বুক তেষ্টা নিয়ে বিছানা থেকে নেমে ছাদের দিকের জানলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে মধ্যরাতের ছাদের বাগান। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে আত্মহত্যার অজস্র প্ররোচনা—নানান মাপের বিষের শিশি, নীচু পাঁচিল, অজস্র ধারালো যন্ত্র, প্লাস্টিকের ব্যাগ, দড়ি। সেই সবের মাঝখানে আমার দিকে পেছন ফিরে ইটের বেদির ওপর তখনো একইভাবে বসে আছে সোমনাথ। শুধু এখন ও আর একা নয়। ওর কাঁধের ওপর মাথা রেখে বসে আছে জয়িতা। জয়ীর একটা হাত এমনভাবে সোমনাথের রোগা শরীরটাকে জড়িয়ে রেখেছে, মৃত্যুর পক্ষেও সেই বাঁধন খুলে সোমনাথকে নিয়ে যাওয়া কঠিন। দেখলাম, ওদের ঠিক সামনে সার সার বারোটা টবে বারোটি রাজকন্যা—তেমনই তন্বী, তেমনই শুভ্র, তেমনই স্বপ্নগন্ধা। ভুঁইচাঁপা ফুটেছে। ওরা দুজনে সেই ফুলের দিকেই তাকিয়ে বসে রয়েছে।

যে তেষ্টা নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠেছিলাম, সেই আমর্ম তেষ্টা নিয়েই বিছানায় ফিরে এলাম। শুলাম না, বিছানার ধারে পা ঝুলিয়ে বসলাম। সোমনাথের জন্যে গতকালই বড় এক শিশি তরল কীটনাশক কিনে এনেছিলাম, ওকে দেওয়ার সময় পাইনি। শিশিটা আমার বেডসাইড টেবিলেই রাখা ছিল। আমি পুরো তরলটা আমার গ্লাসে ঢেলে নিলাম। 

বেশ বুঝতে পারছিলাম, আমার এ তেষ্টা জলে মিটবার নয়।

Comments