গুহাচিত্র
সৈকত মুখোপাধ্যায়
বহুদিন বাদে সেদিন সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার সামন্তর চেম্বারে বসে বিজুরিকে সামনাসামনি দেখেছিলাম। সেটা এপ্রিল হতে পারে, কিম্বা ডিসেম্বর। গ্রীষ্ম কিম্বা শীত। চেম্বারটা এয়ারকন্ডিশনড ছিল বলে আমার শীত গ্রীষ্মের কোনো স্মৃতিই নেই। তবে বর্ষাকাল ছিল না এটুকু বলতে পারি। কারণ ডাক্তারবাবুর চেয়ারের পেছনের কাচের জানলার ও পারে কলকাতার স্কাইলাইন বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। বৃষ্টি ছিল না।
বিজুরি আমার বিবাহিতা স্ত্রী। একই ফ্ল্যাটে আমাদের ঠিকানা। তবুও দিনের পর দিন দুজনের দেখা হয় না। ওর শরীরের অনেক কিছুই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। না, ভুল বললাম শরীর নয়, শরীর তো সব মেয়েরই এক। বলাকার শরীর ঘাঁটলে বিজুরির শরীরের কথাও মনে থেকে যায়। আসলে মুখ। বিজুরির মুখের কিছু কিছু জায়গা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। যেমন সেদিন ডাক্তারের চেম্বারে বসেই খেয়াল হল, ওর তিলটা যেন কোন গালে? বাঁ না ডান?
আড়চোখে চেয়ে দেখলাম—বাঁ।
চশমার ফ্রেম? গোলাপি না নীল?
সেটাও দেখতে গেছি, এমন সময় উল্টোদিকের চেয়ার থেকে ডাক্তার সামন্ত গম্ভীর গলায় বললেন, এই যে মিস্টার, আমার দিকে তাকান। প্রবলেমটা কী আপনাদের?
বিজুরি তাড়াহুড়ো করে বলল, স্যার, ও, মানে অনাবিল, আমার হাজব্যান্ড, গতকাল সুইসাইড করতে গিয়েছিল। মেট্রোয় ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছিল। কোনোরকমে প্লাটফর্মের অন্য লোকেরা আটকেছে।
বিজুরি যা বলল তা সত্যি কি না আমার জানা নেই। ওরকম কোনো ঘটনা আমার মনে পড়ছে না। তবে আমি অন্য একটা ঘটনা জানি। আমাদের বাথরুমের দেয়ালে বিজুরির প্রসাধনী রাখার যে পাল্লা দেওয়া ছোট আলমারিটা আছে, তার মধ্যে বিজুরি ক্রমাগত ভ্যালিয়াম আর অ্যালজোপাম জমা করে চলেছে। আমি যখনই ওটা খুলি, দেখি আগের চেয়ে একটা দুটো ফাইল বেশি। যেন শীতের আগে কাঠবেড়ালি গাছের কোটরে বাদাম জমাচ্ছে।
ডাক্তার সামন্তকে সেটাই বললাম।
ডাক্তার সামন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে যেভাবে নানান জ্যামিতিক নকশায় ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করলেন আর মাঝে মাঝে হাত দিয়ে বাতাস কাটতে লাগলেন তাতে ওনাকে সামন্ত নয়, 'সামান' মনে হচ্ছিল। সামান মানে গুণীন টাইপের ব্যাপার। ধর্মগুরু আর ম্যাজিশিয়ানের মিশেল। তারা নাচে, গান গায়, মুঠো মুঠো ধুনো পোড়ায়, পায়রা বলি দেয়। ধড়ফড় করে মাটিতে পড়ে যায়। ধুলোয় গড়াগড়ি খায়। তারপর সেই ভরের মধ্যেই আদিম মানব কিম্বা আদিবাসী মানুষদের নানান রোগের ওষুধ বলে দেয়।
সামন্ত আর সামান শব্দ দুটো যে এত কাছাকাছি সেটা হঠাৎ খেয়াল পড়ায় ফিক করে হেসে ফেললাম।
হোয়াটস দা ম্যাটার উইথ ইউ? নাচানাচি থামিয়ে চোখ কুঁচকে জিগ্যেস করলেন সামান, স্যরি সামন্ত।
আমি বললাম, নাথিং স্যার।
যাই হোক, ডাক্তার সামন্ত তারপরে আমাদের নানান রকম প্রশ্ন করলেন। আমরা জানালাম, বিয়ের পর থেকে আমাদের একেবারেই দেখাসাক্ষাত হয় না, যদিও আমরা এক ফ্ল্যাটেই থাকি। তার কারণ আমরা দুজনেই আই টি সেক্টরে কাজ করি। আমার নাইট ডিউটি আর বিজুরির ডে। বিজুরি বাড়ি ফেরার আগে আমি অফিস চলে যাই, আমি বাড়ি ফেরার আগে বিজুরি অফিস চলে যায়। এই যে আজ এখানে একসঙ্গে দুজনে এসেছি, সে-ও বিজুরি ছুটি নিয়েছে বলেই সম্ভব হয়েছে।
বিজুরি বলল, আমরা বাঁচতে চাই ডাক্তারবাবু। আমি চাই না, সত্যিই কোনোদিন একসঙ্গে সবক'টা অ্যালজোপাম খেয়ে নিতে।
আমি বললাম, আমিও থার্ড রেলের ওপর শুয়ে শুয়ে শিককাবাব হতে চাই না স্যার।
ডাক্তার সামন্ত বললেন, তাহলে ছবি আঁকুন।
দুজনেই জিগ্যেস করলাম, কার ছবি স্যার? কিসের ছবি?
নাথিং ইন পার্টিকুলার। যা প্রাণে চায় আঁকুন। এইভাবেই অবচেতনের ভেতরের বিষগুলো সব বেরিয়ে যাবে। জীবনের প্রতি আকর্ষণ ফিরে আসবে।
আমি অন্তত আধমিনিট হতবাক হয়ে বসে রইলাম। এ তো চল্লিশ হাজার বছর আগের নব্য প্রস্তর যুগের 'সামান'দের প্রেসক্রিপশন। আরে, এই কারণেই তো আলতামিরায়, ভীমবেঠকায় গুহার দেয়ালে দেয়ালে এত ছবি। এমনি এমনি ওরকম সব ভয়ঙ্কর প্রাণীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের ছবি আঁকা হত নাকি? তারপরে নগ্নিকা? অমন লার্জার দ্যান লাইফ স্তন, নিতম্ব, ভগদেশ! ক্যাথারসিস, ক্যাথারসিস। এ তো একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। কিন্তু সেই প্রেসক্রিপশন আজ আবার চল্লিশ হাজার বছর বাদে এই পার্কস্ট্রিটের চেম্বারে! এটা টু মাচ নয়?
ডাক্তার সামন্ত কী এবারে ফি নেওয়ার সময়ে পাঁচশো টাকার নোটের বদলে একটা পাথরের বল্লম চাইবেন? কিম্বা ম্যামথের মাংস?
যাই হোক, এইভাবেই আমাদের ছবি আঁকার শুরু। প্রথমে ড্রইং খাতা আর প্যাস্টেল কিনে এনে তাই দিয়ে আঁকা শুরু করেছিলাম। তাতে ঠিক ফুর্তি পাচ্ছিলাম না। এইসব মিডিয়ামে ছবি আঁকলে আপনা আপনিই হাত থেকে ছোটবেলায় শেখা তিনকোনা পাহাড়, কাঁটা-ওলা সূর্য, কু ঝিক ঝিক রেলগাড়ি এইসব বেরিয়ে আসে। তাতে ডিপ্রেশনটা আরও চেপে বসে। মনে পড়ে যায় অনেকদিন সূর্য দেখিনি, পাহাড়ও না।
বিজুরি ফোন করে জানাল ওরও একই অবস্থা।
তারপর কেমন করে যেন অটোমেটিকালি আমরা ফ্ল্যাটের দেয়ালে ছবি আঁকতে শুরু করে দিলাম। তখন থেকেই ছবির চরিত্রও বদলে গেল।
প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে মাজা মসৃণ মাখন রঙের দেয়াল— সব মিলিয়ে তা ষোলোশো স্কোয়ার ফিট তো হবেই। প্রথম দিন আমি খুব সসঙ্কোচে সোফার পেছনে আড়াল হয়ে থাকা দেয়ালের টুকরোটায় একটা অ্যাক্সিডেন্টের ছবি আঁকলাম। টাটা সুমো আর লরি, হেড অন কলিশন। দুটোই দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে। রক্তাক্ত কিছু দেহ পাশে রাস্তায় শোয়ানো রয়েছে।
আঁকার পর নিজের মনেই ছবিটার তারিফ না করে পারলাম না। এর সমগোত্রীয় ছবি রয়েছে সাব-সাহারান আফ্রিকার উখালাম্বায়। গন্ডার শিকারের ছবি। সে-ও ভারি রক্তস্নাত হিংস্রতায় ভরা গুহাচিত্র।
আমি নাইট ডিউটি করে এসে দিনের বেলায় ঘুমোই। তাই আমাদের ফ্ল্যাটের সমস্ত জানলায় ভারি পর্দা টানা থাকে। সন্ধেবেলায় বিজুরি বাড়ি ফিরে সেই পর্দা আর সরায় না। বরং কম পাওয়ারের একটা আলো জ্বেলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। সারা দিন কম্পিউটার স্ক্রিনের ঔজ্জ্বল্যের দিকে চেয়ে থাকার পরে চোখ আর আলো সইতে পারে না। তাই আমাদের ফ্ল্যাটে চির আবছায়া। গুহার মতন। সেই আবছায়ার মধ্যে গাঢ় রঙে না আঁকলে ছবি ভালো ফোটে না। এটা আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরে গেলাম।
হ্যাঁ, আমরাই বলছি। কারণ ইতিমধ্যেই আমার আঁকা ছবিগুলোর আশেপাশে অন্য হাতে আঁকা কিছু কিছু ছবিও গজিয়ে উঠতে দেখছি। বিজুরির আঁকা সেই ছবিগুলোর মধ্যে একটা ছবি আমার বেশ ভালো লেগেছিল। একটা কম বয়েসি ছেলেকে তিন-চারটে লোক ঘিরে ধরে পেটে ছুরি ঢুকিয়ে মারছে। আর একটা মেয়ে, ওই আক্রান্ত ছেলেটার দিদিই হবে, সে বন্ধ ফটকের সামনে দু-হাত তুলে বাঁচাও বাঁচাও বলে সাহায্য চাইছে। ছবিতে তো আর চিৎকার শুনতে পাওয়ার কথা নয়। তবে বিজুরির আঁকার গুণে যেন তাও শোনা যাচ্ছিল।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আবছায়া আলোয় প্যাস্টেল-কালার একেবারেই খুলছিল না। কী করি, কী করি? তারপর হঠাৎই একেবারে গুহাচিত্র আঁকবার অরিজিনাল মালমশলা হাতে চলে এল। অফিস থেকে ফেরার সময় দেখি খালপাড়ে বস্তি উচ্ছেদ হচ্ছে। মানে হয়ে গেছে। এখানে ওখানে পোড়া কাঠ, ভাঙা উনুন, তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের কড়াই এইসব পড়ে রয়েছে। আমি টুক করে গাড়ি থেকে নেমে আমার যা যা প্রয়োজন সব তোয়ালেতে মুড়ে গাড়িতে ঢুকিয়ে নিয়ে এক্কেবারে সোজা আমার ফ্ল্যাটে।
তারপর থেকেই আমাদের গুহাচিত্রগুলো কাঠকয়লার কালো, পোড়ামাটির লাল আর বিতাড়িত মানুষদের অভুক্ত শাকপাতা-সেদ্ধর সবুজ রঙে রঙিন হয়ে গেল। মনে হয় এগুলোও আগামী পঁচিশ তিরিশ হাজার বছর টিকে যাবে।
ইতিমধ্যে একদিন সেক্সের প্রয়োজন বোধ করায় আত্মহত্যার হেল্পলাইনে ফোন করলাম। ওরা কেন যে সোয়েট-শপটার এরকম নাম দিয়েছে কে জানে! 'আত্মহত্যার হেল্পলাইন'! আমি প্রথমবার সত্যিই ভেবেছিলাম বোধহয় কাউন্সেলিং সেন্টার-টেন্টার হবে। তারপর দেখি, ও বাবা, বেশ চমৎকার এক মেয়েমানুষ এসে হাজির। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই ওদের ডাকি। খুব যে ভালোলাগে তা নয়। তবে, ওই...ওদের মধ্যে দিয়ে বিজুরির শরীরটা ঝালিয়ে নিই।
আজকে যে এল, তাকে আমি মনে মনে নর্থ পয়েন্টের মা বলে ডাকি। আসলে এরা তো কেউই নামটাম বলতে চায় না। তবে আমার টেবিল থেকে নোটগুলো নিয়ে যখন ব্যাগে ঢোকাতে যায়, তখন প্রায়ই ওদের পার্স থেকে কোনো না কোনো স্কুলের পেরেন্টস আইডেন্টিটি কার্ড বেরিয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। আমি ভদ্রতাবশত সেগুলো কুড়িয়ে ওদের হাতে তুলে দিই। কোনোটা নর্থ পয়েন্টের, কোনোটা ভারতী শিক্ষাভবনের, কোনোটা মহাযোগী অ্যাকাডেমির। ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। বাচ্চাদের স্কুলে ঢুকিয়ে ওরা জীবনটাকে উপভোগ করতে বেরিয়েছে। আবার স্কুল ছুটির সময় যথাস্থানে পৌঁছে, বাচ্চাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে।
তো নর্থ পয়েন্টের মা পূর্ণ যুবতী। চমৎকার শাঁসে জলে শরীরস্বাস্থ্য। গরিবি কিম্বা অপুষ্টির কোনো বালাই নেই। যেভাবে অবহেলায় নোটগুলো হাতে নেয় তাতে বোঝাই যায় ওর হাজব্যান্ড এরকম নোট জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাতে পারে। তবে কী জন্যে আসা?
সে আমি বলতে পারব না। তবে একটা জিনিস দেখে অবাক হলাম, ভালোও লাগল। আমার বিছানার মাথার কাছের দেয়ালে সবে মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে এক নগ্নিকার ছবি এঁকেছিলাম। পোর্ট্রেট নয়, অনেকটা সিল্যুয়েটের মতন। বুরুশে ধ্যাবড়া করে রং তুলে পোঁচ বুলিয়ে আঁকা। গুহাচিত্রের শর্ত মেনেই সেই ছবিতে স্ত্রী যৌন অঙ্গগুলোকে অস্বাভাবিক বড় করে দেখিয়েছিলাম। আর্কিওলজিস্টদের ভাষায় এইধরনের মানবীচিত্রগুলোকে আদিখ্যেতা করে বিশ্বমাতৃকা বলে ডাকা হয়। তো, সেই ছবি দেখে নর্থ পয়েন্টের মায়ের কি যে হল। চোখ জলে ভরে উঠল। শুধু তাই নয়। দেখি তার স্তনবৃন্তে দুধের ফোঁটা জমছে। চোখের জলের ফোঁটা আর বুকের দুধের ফোঁটা একসঙ্গে টপটপ করে আমার গুহার মেঝেয় ঝরে পড়তে লাগল। আজকে আর টাকা নিল না সেই মেয়ে। তাড়াতাড়ি পোশাকটোশাক পরে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। সম্ভবত বাচ্চার জন্যে মন কেমন করে উঠেছে।
আজকাল যতক্ষণ বাড়িতে থাকি, পুরো সময়টাই প্রায় ছবি এঁকে কাটাই। মনে হয় অফিস না গিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা আঁকতে পারলে আরো ভালো লাগত। ছবি আঁকি, আর মনে মনে ডাক্তার সামন্তকে তারিফ করি। উনিই মনে হয় প্রথম আবিষ্কার করেছেন যে, আমরা যারা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ কবি, তারা আদতে গুহামানব। ওনার একটা ওয়েবসাইট আছে। সেটাতে এক দুই করে মিলগুলো দেওয়া আছে। সেগুলো হল যথাক্রমে—
এক, আদিম মানুষের ইতিহাস ছিল না, ভূগোল ছিল না, সাহিত্য ছিল না, দর্শন ছিল না। কেবল রিচ্যুয়ালস ছিল। মাল্টিন্যাশনালের চাকুরেদেরও তাই। তাদের রিচ্যুয়ালসের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে কেনাকাটা করা, কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে গান শোনা ইত্যাদি বহুল প্রচলিত।
দুই, আদিম মানুষেরা ছোট ছোট গোষ্ঠিতে বিভক্ত ছিল এবং গোষ্ঠির বাইরে চরম অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। মাল্টিন্যাশনালের কর্মীরাও তাই। একরকমের পোশাক পরিধান, গোষ্ঠির মধ্যে প্রচলিত এক বিশেষ ধরনের সঙ্কর ভাষা ব্যবহার—এগুলি এদের গোষ্ঠির সঙ্গে একাত্ম করে রাখে। এদের গোষ্ঠিপতির নাম ম্যারিকা।
তিন, আদিম মানুষেরা টোটেম পুজো করত। কারুর টোটেম মাছ, কারুর টোটেম কচ্ছপ, কারুর বা জাগুয়ার। সেই টোটেমের চিহ্ন সারাক্ষণ তারা শরীরে বহন করে বেড়াত। মাল্টিন্যাশনালের কর্মীরাও তাদের চৌকোণা আই-কার্ডগুলি সারাক্ষণ শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। সম্ভবত প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দেওয়ার সময়েও কোম্পানির লোগো আঁকা ল্যামিনেটেড কার্ডগুলি তাদের গলায় বা কোমরে শোভা পায়।
এইরকম সব আরকি। সবটা মনেও নেই।
কিছুদিনের মধ্যেই অফিস থেকে ওয়ার্নিং খেলাম। বিজুরি এস এম এস করে জানাল ওরও একই অবস্থা। আসলে আমাদের গুহাচিত্রগুলো গুহার বাইরে বেরিয়ে পড়ছিল। অফিসের কম্পিউটারে আমেরিকান ক্লায়েন্টের জব ওয়ার্ক করে দেওয়ার বদলে আমরা অসাবধানে দুয়েকটা গুহাচিত্র পোস্ট করে দিচ্ছিলাম। আমি একবার একটা পারমানবিক বর্জ্য বোঝাই জাহাজ আঁকলাম, যেটা গুজরাটের সমুদ্র উপকূলে সেই বিষাক্ত বর্জ্য খালাস করছিল। বিজুরি এঁকেছিল চীনের গুয়াংডাও প্রভিন্সের খেলনা কারখানা। আঙুলে ক্ষত, নাকে রক্ত নিয়ে মেয়েরা সেখানে ম্যাকডোনাল্ড কোম্পানির জন্যে ভ্যালেন্টাইনস হার্টে রং লাগাচ্ছে। প্রতি তিন সেকেন্ডে একটা হৃদয়ে রং লাগাতে হয় তাদের। তা না হলে পুরো দিনের মজুরিটাই জরিমানা হিসেবে কেটে নেওয়া হয়।
হিমযুগ। বাইরে অবিশ্রান্ত বরফ পড়ছিল। আমরা দিনের পর দিন নিষ্ঠুর তুষারপাতের মধ্যে গুহাবন্দী হয়ে বসেছিলাম। আমাদের দৃষ্টি ছিল, দর্শন ছিল না। ভাষা ছিল, কবিতা ছিল না। জন্ম ছিল, অপত্য ছিল না। মৃত্যু ছিল, সৎকার ছিল না। সঙ্গম ছিল, ভালোবাসা ছিল না। আমাদের সময় কাটে কেমন করে?
আমাদের পাগল পাগল লাগছিল। একজন দুজন করে আমরা আত্মহত্যা করছিলাম।
ঠিক তখনই আমাদের 'সামান', আমাদের ওঝা, আমাদের জানগুরু গুহার জটিল সুড়ঙ্গজালের শেষপ্রান্তে আমাদের টেনে নিয়ে গিয়ে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সজারুর কাঁটার কুইল, বেজির লোমের তুলি, রক্তিম গেরিমাটি, সবুজ তামার আকরিক, কালো কাঠকয়লা। গুহার দেয়ালে মশাল জ্বেলে দিয়েছিল।
আমরা গুহাচিত্র এঁকেছিলাম। বাইরে তখন জমে যাওয়া বেরিংপ্রণালী পেরিয়ে ইয়োরোপের নেকড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছিল। শান্ত নিয়ান্ডারথাল মানুষদের শেষ প্রতিনিধিকে খুন করছিল হোমো স্যাপিয়েন্সেরা, খুনে বনমানুষের বংশধরেরা।
আমরা গুহাচিত্র আঁকছিলাম। বাইরে বাঁধের জলে ডুবে যাচ্ছিল মানুষের ঘরবাড়ি। দৃষ্টিনন্দন ভাবে মরুভূমির আকাশে মিসাইল হানা চলছিল। কিশোর সাইকেল চোরকে লাইটপোস্টে বেঁধে তার চোখ উপড়ে নেওয়া হচ্ছিল। মেয়ের সামনে ধর্ষণ করা হচ্ছিল মাকে।
আঁকতে আঁকতে একদিন আমি অফিস যেতে ভুলে গেলাম। জানতাম চাকরিটা চলে যাবে। যাক। পরোয়া করি না।
আঁকতে আঁকতে বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হল। সন্ধে পেরিয়ে রাত।
ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে বিজুরি তার ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল, যেভাবে রোজই ঢোকে। তারপরে অবাক হয়ে দেখল আমি ভেতরেই আছি। ছবি আঁকছি।
বিজুরি ধূসর রং দিয়ে একটা হুইল চেয়ার এঁকে অফিসে চলে গিয়েছিল। আমি সেই চেয়ারটার ওপর ইচ্ছেসুখে লাল নীল রং লাগিয়ে সেটাকে একটা প্যারাম্বুলেটর বানিয়ে দিয়েছি। তাই দেখে, বিজুরি আজ চল্লিশ হাজার বছরের দূরত্ব পেরিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। হাঁটু মুড়ে বসল আমার পাশে। কত যুগ বাদে ওর ঘন নিশ্বাস আমার কানের পেছনে এসে লাগল। আমি হঠাৎ ঘুরে প্রাণপণে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
বাইরে তুষারযুগের শেষ বরফকণাটা সেই মুহূর্তেই টুপ করে গলে পড়ল।
Comments
Post a Comment