হানাবাড়ির কারখানা - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর


হানাবাড়ির কারখানা

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর


সূচিপত্র -

ফুল-বউ

আঁধার কোটা

দাদাশ্বশুরের ঘড়ি

দেয়ানের চটি

ছিটওয়ালা কাক

গুমগুমি


ফুল-বউ

ঊনপঞ্চাশ মহল নিয়ে দুপুলিয়ার সাবেকি আমলের রাজবাড়ি-এখন হয়েছে সেটা হানাবাড়ি ৷ এই দুপুলিয়ার রাজবাড়ির দুমুখে ছিল দুটো পুল ৷ তার এক পুল দিয়ে ঢুকত বিয়ের বরাত, আর এক পুল দিয়ে বার হতো মড়ার-খাট-এই ছিল দস্তর ৷ পাটরানী থেকে ফুলবউ, এর মাঝে অগুনতি বাঁদী, এক-এক রাজার বিয়েতে যৌতুক করা-ঊনপঞ্চাশ মহলা বাড়িতে কৌতুকে থাকত ধরা ৷ কোন রানী মলে কে নেবে তার স্থান, এই নিয়ে চলতো তাদের মধ্যে আড়াআড়ি ৷ জলটুঙি, হামাম, কাচমহল, খাসমহল, রানিমহল এতো ছিলই, তার উপরে কোঠার পর কোঠা, কুঠরির পরে কুঠরী,ঘরের পর ঘর –সব ঘরের খবর নির্ণয় করতে হারি, এত বড়ো সে দুপুলিয়া রাজবাড়ি ৷ সে সংসারে যে একবার ঢুকলে সেই বুঝলো যন্ত্রনা নেই বেঁচে থাকার তুল্য ৷ জানের মূল্য নিয়ে তাই কেউ করতো না বাড়াবাড়ি ৷ কুল-কিনারা পাওয়া যেত না এত বড় ফুল বাগান,তারি মধ্যে শ্বেত পাথরের বাঁধানো ফুলটুঙি ঘর-তিন দিকে তার ফুলের কেয়ারি, একদিকে সান্ নদী-একবেলা লাগে দিতে পাড়ি ৷ উড়ো ভাষায় শোনা যায়-এই ফুলটুঙির বাগিচায় এলো একদিন রানির সাজে কোন এক ফুলমালির মেয়ে দোল-পূর্নিমায়, এক হাতে রাজার হাত, আর এক হাতে পিচকারী ৷মধুরাত পূর্নিমার, ঘড়ি পড়লো একটার-হয়ে গেলো সুনসান রাজবাড়ি বাগান ৷ সকালে দেখা গেল ফুলমালির মেয়ে কোথা ভেসে গেছে সান নদী বেয়ে, ফুলটুঙি ঘরে ফুলের বাসর রেখে খালি ! হুকুম হল রাজার-ফুলটুঙি মহল ধোলাই করবার-ধারা দিয়ে পড়লো নালি বহে আবীর কুমকুম কেশরের লালি ৷ শ্বেত পাথরের টালি যেমন সাদা ছিল তেমনি হল, শুধু লেগে রইল পাথরের তক্তে যেন লোহার কষের মত,শক্ত চাপ রক্তের মতো রাঙা দাগ একটা দাঁড়ি ৷ ওঠানো গেল না ঘষে সেটা জল বালি ৷ মস্ত রাজবাড়ির মস্ত কারখানা,তার মধ্যে কে করে ঠিকানা-দাগটা রেখে গেল কিনা যাবার কালে ফুলওয়ালী ! বাদ এক বছর ৷ দুপুলিয়াতে দেয়ালি রাতে আকাশ পাঠালো ঝড় জলের ঝাপটা; দশটা কি এগারোটা কে করে ঠিক হওয়া কাঁদছে, যেন প্যাঁচার খপ্পরে চেঁচাচ্ছে শালিক ! হয়ে ত্রস্ত, রাজারে খবর দিল নফর-অন্দরের দোরে কড়া নাড়ছেন এক কাপালিক-হাতে একখানা কাস্তে মস্ত ! হুকুম হলো ফুলটুঙি ঘরে কাপালিককে বাসা দিতে ৷ বসবে ভৈরবী চক্কর-বুঝে নিল নফর রাজার একটু ইঙ্গিতে ৷ সেদিন ফুলটুঙি ঘরে রাত দুই প্রহরে বাঘাসনও পড়লো রাজাসনও পড়লো দুই জনার ৷ হুকুম নাই চাকর নফর কারো ঢোকবার,কি চৌকিদার কি চোপদার ৷ বাহিরে ঝড় ঝাপটার মাতন ফুলবাগান দলে ফুলটুঙিতে ৷ ভিতরে ফিরছে ঘন ঘন কাড়ন মরা মানুষের মাথার খুলিতে ৷ ঝড়ের গর্জনে মিলছে থেকে থেকে অট্টহাস ৷ ঝনঝন দুলছে ঝাড়, পর্দা উড়ছে এপাশ-ওপাশ ৷ শব্দে হচ্ছে, যেন নৃত্য করছে দুটো পিশাচ ৷ রাজার খাস কামরার আলো জ্বলছে নিভছে, দেখা যায় ঘুলঘুলিতে ৷ ক্রমে দেয়ালির রাত হল অবসান-ভোরের আলোতে অস্পষ্ট প্রতীয়মান ফুলটুঙির ভাঙা ফুলবাগান ৷ ফুলটুঙি ঘরে জাগাতে গিয়ে রাজারে, দেখে গিয়া ভোর বেলাতে নফরে-না কাপালিক, না রাজা কেউ বর্তমান ! ঘরটায় ভর্তি পোড়া মাংস আর তাজা রক্তের ঝাঁজা গন্ধ ৷ সে পায়ে পায়ে পিছিয়ে দোর করে দিল বন্ধ ৷ মহল ধোলাই করিয়ে ভৈরব দেয়ান নীরব থাকতে হুকুম দিলেন বাগেয়ানকে শপথ দিয়ে শক্ত ৷ হাত ফেরালো ফুল বৌয়ের যাবার পর দুপুলিয়ার রাজতক্ত ৷ কেউ বললে, রাজাটা ছিল মহাপাপী, কেউ বললে ছিল মহাভক্ত ৷



আঁধার কোটা

কাচমহল, খাসমহল, বিবিমহল, মালাঘর, তারপরে গড়বন্দী আঁধার কোটা খাজনা ঘর ৷ মোহনার সেখানে বসে দুপুর রাতে দুপুলিয়ার খাস তহবিলের হিসেব রাখে ঘড়া উল্টে ঢেলে মোহর- এক হাতে দাঁড়িপাল্লা, আর এক হাতে মাল্লাদের জল সেঁচা ডোঙার মতো চৌকোনা গাম্ভার কাঠের পাত্তর ৷ এমন মোটা দেয়াল, ভারি দরোজা খাজনা-খানার যে ঝনঝন টাকা ঢাললে শব্দ পৌঁছায় না বাহিরে তার ৷ সেখানে সাবধানে ওজন করছেন রাজার প্রয়োজনের নিজ খরচি ৷ খাস-মোহরার যেন একটা বুড়ো যক্ষি-পিপুমের আলো পড়েছে টাক মাথার উপর; ভিতর হতে দুয়োর বন্ধ, কোমরে ঝুলছে চাবি শিকলি তার-বাহিরের কারো উপায় নাই হঠাৎ প্রবেশ করবার ৷ কী করে সেখানে সিঁদ-কাঠি, কি করে শাবল ! খাজনা ঘরের পারে গন্না-কাটার মাঠ ৷ তার একধারে খাড়া সামনা-সামনি দুটো ফাঁসিকাঠ-তাতে ঝুলছে একটা মড়া-কে জানে কোন কালে ফাঁসিতে চড়া- শুকিয়ে ফেলেছে সেটারে কত দিনের হিম জল রোদ ৷ দুলছে সেটা আজ করছে যেন বোধ প্রাণ পেয়ে গেছে অক্স্মাৎ ৷ তারি শিয়রে রাত দুপুরের ঝড়ে পড়েছে নজরে গ্রহনে খাওয়া খানিকটা চাঁদ ৷ এত ঝড়ে বার হয় না কুকুর শেয়াল-ফাঁসি কাঠের তলে জুটেছে বেঘোরে কালো মূর্তি চার ৷ এ ওরে বলছে-কে আছ রে জোয়ান-ভেঙে আনো দেখি কবজী সইতে মরা মানুষের হাতের মুটখান ! আঁধার ঘুট-ঘুট, কে উঠবি উঠ, ফাঁসি-কাষ্ঠে কে আছিস সেয়ান ! ধর গন্না-কাটা নাপিতের দাড়ি কামান আস্তরি-কেটে আন মড়ার মাথার পাঁচ গাছা চুলি ৷ দেখে না যেন ভুতের দেয়ান ৷ পালোয়ান কে-...কে আছিস ধর না চেপে মড়াটার উল্টো পা দু খান ৷ হয়েছে; হয়েছে যা চাই হাত হয়েছে ৷ আরে মড়ার বেম্মতালুটা কোন দিকে রয়েছে ! ওরে টিকি থাকে যেদিকে ৷ নে চটপট ঘুরে দে টান ৷ রাত হচ্ছে ফিকে, চোরের মায়ের ঘরের দিকে কাজ সেরে দে পিট্টান ৷ চোরের মা থাকে সান নদীর বাঁকে, বুড়ীর বয়েসের গাছ পাথরের হিসাব ধরে কে ! তবক্ষুর মতো কোটর-গত চক্ষু দুটো তার, নাকটা যেন সাতকেলে কাল পেঁচার ৷ উনুন-মুখী উকুন বাছতে আছে একটা রামছাগলার-কোলের পরে রেখে ৷ তারে দেখে মনে হয় ছাগলীর মা বুড়ী ছাগলের সিং এ মারে সে ঘামাচি ফুসকুড়ি ৷ কেউ তারে বলে ডাইনি বুড়ী, যক্ষি বুড়ী, খায় শেয়ালের নাড়ি-ভুঁড়ি ৷ কাল পেঁচি আর দাঁড়-কাগের জুড়িদার সে বসে আছে কম্বল মুড়ি ৷ চোখের তারা তার কালো বেড়ালটা, দিষ্টি দিয়ে রাতে জ্বলে ৷ সে খায় ইঁদুর ভাজা ধরে খাঁচা কলে ৷ চোরেরা সবাই তারে উল্টো মা বলে ৷ সে যদি পড়ে দেয় উল্টো মন্তর ভিতরের আগড়ে-কী করে আপনি খুলে যায় রাজ ভান্ডারের দোর-অক্লেশে সেঁধিয়ে যায় চোর ! পাল্টা মন্তর ঝাড়ে যদি বুড়ী-বাহির থেকে কপাট পড়ে যায়, অঘোর নিদ্রায় সবাই পড়ে-ঢুলি – চোর পালিয়ে যায় বহে চোরাই মালের ঝুড়ি-ভয়ানক বুড়ী সে থুত্থুড়ি ৷ চার চোর তারে দাঁড়ালো ঘিরে, বুড়ী পাকালো সলতে মড়ার চুল চিরে ৷ মড়ার মুঠাতে ধরিয়ে দিলে সেটা-ফুঁক- মন্তর একটা পড়লো বুড়ী ধীরে ধীরে –

‘ ‘খোল খোল আগল কুলুপ কুঞ্জি

খোল নী:সাড়ায় ,এই দুই তিন গুনতি ৷

জ্বলছে পিদুম মড়ার হাতে

আলো পড়ুক ধনের ঘড়াতে

তিন দুই এক গুনতি ৷

কাক পেঁচা থামাক চেঁচামেচি,ঘড়ি থেমে যাক ৷

উল্টাক পাল্টাক চার কড়া কড়ি ঘেঁচি

চোর পালাক তো বুদ্ধি বাড়াক ৷

কুবের ভান্ডারে বেজি এদিকওদিক ফিরে

বসে থাক দুই তিন এক,এক দুই ফাঁক গুনতি !’’

মন্তর পড়া মড়ার মুঠার চাপে দুপুর রাতে মড়ার মতো ঘুমিয়ে আছে দুপুলিয়ার লোক ৷ বাঘের ঘরে ঘুমায় বাঘ-দুপুরিয়া ডাকাত দুপুলিয়ায় ঢোকে- বাঘের ঘরে যেমন যোগ ! মড়ার হাতে চেরাগ প্রদীপ, পগার পারে করল ঝিকমিক-যেন আঁধার কোটার বাহিরে একটা জ্বলছে নিভছে জোনাক পোক ৷ মড়ার হাতের উল্টো মন্তরে অবাধে চোর যায় চলে-শব্দ হয় না,পা পিছলায় না, দোর আলগায় না আগড় কুলুপ, অন্ধকারে প্রকাশ পায় সুনসান রাজবাড়িটায় যা আছে যথায়-চোর জেনে যায় অলিগলির সন্ধান সুলুক ৷ নি:শব্দে খোলে খিড়কি দরজা- যেন এল পালিসে সাফ মির্চি-ধরা কল কবজা ৷ অলিগলি চোর যায় চলি-মড়ার মুঠায় চুলের সলি-আলো ফেলায় সবজা ! পড়ে চার চোরের পা উল্টো মন্তরে তিন দুই এক, দুই এক তিন করে, যায় ধাপে ধাপে সিঁড়ি চড়ে ৷ কারো দেখা নাই,ঘুমায় অঘোরে শাস্ত্রি-সেফাই –সং যেন রেখেছে কেউ মাটিতে গড়ে ৷ শ্বেত পাথরের কাটা,জালি দিয়ে ঘেরা ঘুমায় আসান পাষান ৷ সান-নদী পারে দুপুলিয়ার জানালা মহলটা-কাচমহল,নাচমহল,খাসমহল-মহলের পর মহল, কোথাও নাই পাহারা টহল-ঘড়িয়াল ঘুমায় পড়ি,রাত কত ঘড়ি খোঁজ নাই সেটা ৷ বুড়ী দিয়েছে উল্টো মন্তর পড়ি দু-কুড়ি নয় বার ৷ সময় পায়নি কুলুপ লাগাতে খাজনা খানার খাস মোহরার-ঘুমের তাড়াতে বাসাতে শুয়ে আছে বেহুঁশিয়ার ! জীবন্ত যা কিছু দেখে ঘুমেতে কাতর,চার চোরে পাতল চক্কর,খাজনা ঘরের কাছ বরাবর ৷ গ্রহনের চাঁদ ধরেছে যেন সোনার ডাবরের ছাঁদ,আঁধার কোটার আলিসার পর ৷

‘খোল খোল আগল কুলুপ কুঞ্জি’

খোল যা আছে বন্ধ-

পেয়ে মড়ার হাতার চুল-পোড়া গন্ধ ৷

পোহাতে না পোহাতে রাত

খোল খাজনা খানার বন্ধ কপাট

ফাঁসিতে লটকা মরা-মানুষের হাত ৷

চল ছুরি ছোরা,শাবল,হাতুড়ি,সিন্ধুক তোড়া ,

ধনের ঘড়া,টাকার তোড়া হাতাক চোর রাত ঘোরা !

তার পরে ওঠে তো উঠুক চন্দ্র-

তার আগে যদি কেউ ওঠে

মড়ার হাতের মুঠায় থাক খাঁড়ার

চোটে হয়ে কবন্ধ ৷’

বন্ধ দোর সহজে খুললো,চার চোর ঢুকলো পায়ে-পায়ে চলি ৷ জ্বলে উঠলো মড়ার মুঠাতে মন্তর পড়া মড়ার চুলের সলি ৷ সোনা রুপার ঝলক-,চার চোরের চোখে লাগাল চমক ৷ চৌকাঠ মাড়াতে চোরে সাক্ষাতে খুলে গেল খাজনার সিন্দুক-শব্দ দিলে দ্রুত বন্দুক ! কোথা ছিল কলের মুরুগ ব্যাঙ্গ দিল-চোর পড়া হু রে বরকন্দাজ অনাচার !কলের মন্তরে খাজনা ঘরে দোর পড়ে গেল- উল্টা পাল্টা মন্তরে হাতুড়ি শাবলে কল-ঘরের কল-কবজা পথ দিলে না চোর পালাতে আজ৷ কলের মোরগের চিত্কারে ভৈরব দেয়ান জাগল যখন যা হল তখন বলে আর কি কাজ ৷



দাদাশ্বশুরের ঘড়ি

গোবিন্দ ঘোষের আদরের নাতনী,দুপুলিয়ার খাস খামারের গোয়ালিনীর তিনি,মেজাজ কিছু শৌখিনী ৷ তিনি লোকটি ছিল ভাল,সইতে পারতো কথা তিক্ত,অতিরিক্ত মেজাজ খোস ঐ ছিল তাঁর দোষ ৷ গোয়ালিনী করলে রোষ,দুপুলিয়ার দেলখোস বাগের হওয়ায় দোষ দিয়ে খালাস হতেন গোয়ালিনীর তিনি ৷ চাকরান বড় ছামের শেষে,গোয়াল-পাড়া ঘেঁষে,গোবিন্দ গোয়ালার বহুকালের পাকা-ভিটে,তারি অধিকারিনী গোয়ালিনী-সব ভালো তার,মেজাজ শুধু খিটখিটে ৷ বিয়ের আগে ধরা পড়েনি এইটুকু জেনে ম্রিয়মান হন যখনি গোয়ালিনীর তিনি-ভালো পান,ভালো বিঁড়ি,শেষে ভালো তাড়ি হতে তাড়াতাড়ি মারামারি হট্টগোলের দলে ভিড়ে খোস মেজাজে অনেক রাতে বাড়ি-মুখো হন কোনমতে পথ চিনি,এমন ঘটে প্রায় প্রতিদিনই ৷ গোয়ালিনী বলে,ঘড়ি দেখ,বেজেছে কয়টা ! গোয়ালিনীর তিনি বলেন, দাদাশ্বশুরের আমলের পুরোনো ঘড়ি,ওর কি চোখ আছে না কান আছে ? বাজাতে দে কানের কাছে- বাজাতে চায় যে কয়টা ৷ খিদে লেগেছে,দে লুচি ভেজে,মেখে ঘি ময়দা ৷ কথায় কথায় লাগে বচসা দু জনাতে ৷ রাতে রাতে বচসাতে রাত প্রায়ই হয় ফরসা ৷ ভঁয়সা বাথানে শব্দ দেয় মহিষ কয়টা ৷ ঘড়িও বাজায় ভোর ছয়টা ৷ গোয়ালিনী বলে,যাই দুধ পৌঁছাই রাজবাড়ি ৷ গোয়ালিনীর তিনি বলে,তা যাও,কিন্তু আসতে চাও তাড়াতাড়ি- জোলাপাড়ায় ওরা বুনেছে যা খাসা শাড়ি,এক জোড়া গুলবাহারি-হাতছাড়া হয়ে না যায় ৷ গোটা কয় টাকা বার কর,বায়না দিয়ে আসি তাড়াতাড়ি ৷ গোয়ালিনী বলে,গুলবাহারি আনতে বলি না ৷ আপনারি দেহটাকে রাত নয়টাতে ফিরে আনতে চাও বাড়ি,না হলে আজ আমারি একদিন কি তোমারি একদিন ৷ ওগো দেখো,দেখো রইবে রইবে কথা,তোমারে বোঝাতে হারি ৷ তিন দিন ঠিক কথা রইল, দাদাশ্বশুরের ঘড়ি কাঁটায়-কাঁটায় নটাই কইলো ৷ তারপরে শনিবারে সকাল নয়টাতে ঘড়িয়াল দম ফেরাতে এল সাবেক কালের দাঁড়ানো ঘড়িটার গোয়ালপাড়ায় ৷ সেই দিন থেকে শুরু হল কথার ফের-ফার ৷ গোয়ালিনীর ঠাকুরদাদার ঘড়ি আর থেমে থাকে না কাঁটায় কাঁটায় রাত নয়টাতে ৷ ফিরে ফিরে রোজ সেই বুলি-চেয়ে দেখতো,চোখ খুলি ঘড়িতে কত রাত? জ্ঞান আছে তো কোনটা কোন হাত ? গোবিন্দ ঘোষের নাতজামাই দেখে বড় কাঁটাটা বারোটাকে ছাড়ায় নাই;ছোট কাঁটাটা বেঁকে চুরে তিনটের ঘরে ভুল করে ঢুকেছে ৷ নাতজামাই বলে,ও গোবিন্দের নাতনী,ঘড়িটার ভীমরতি ধরেছে,নিশ্চয় ছোট কাঁটাটাকে পেত্নীতে পেয়েছে ৷ কালই ওঝা ডেকে ঘড়িটাকে ঝাড়ানো চাই ৷ তাতেও না সারলে ওটাকে কালকে উচিত বউ বাজারে বেচে ফেলাই – ঘড়িটা ঘোড়া হয়ে গেছে দেখতে পাই ৷ কী ! এতবড় কথা !গোবিন্দ ঘোষের ঘড়ি ঘোড়া হয়ে গেছে –তারপরে পেত্নী চেপে আছে ! দেখবে কারে বলে ওঝার ঝাঁটা ৷ তোল তো আর একবার বেচবার কথা দেখবে ছোট কাঁটা ধরে কোন গাছে ! আরে তুলতেই হয় যদি,ঘাড়ে তুলে চুলোর জ্বালে পুড়ায়ে আসব ঘর-কুঁদুলে ঘড়ির ঘাড় ভেঙে ৷ হনুমান থাম ভেঙে হরেছিল মৃত্যুবান-এর আর কী কথা আছে ৷ আমারে দেখালি মৃত্যুবান-ভালো,কাল থেকে দেখি কে সাজে তোর পান ৷ কে ভাজে গরম লুচি ৷ গুম হয়ে রইলো গোয়ালিনীর তিনি মুখ বুজি ৷ শুয়ে পড়লো ঘড়ির কাছটাতে গোয়ালিনী মুখ গুঁজি ৷ সত্যিই সেদিন ছুটলো মৃত্যুবান-আর উঠলো না রাজার গোয়ালিনী নিত্য দুধের দিতে যোগান,সাজতে তেনার মিঠেপান ৷আজকাল সে মানুষ আর নেই,গোবিন্দ গোয়ালার নাতজামাই ৷ হয়ে গেছে ঠিক –বেঠিক ছিল মাথা যেটুক ৷ঘড়ি ঠিক সময়ে করে টিকটিক,ভোর পাঁচটায় তাড়া লাগায় নিয়মিত-রাজবাড়িতে পৌঁছে দাও গা খাঁটি দুধ ৷ নয়তো দেউড়ির দেয়ালে লোহার গজালে আছে ভৈরব দেয়ানের শংকর মাছের চাবুক ৷ হয় না যেন সময়ের এদিক ওদিক ৷ রাত নয়টার ভয়টা গিয়ে ঠেকেছে ভোর পাঁচটায় ৷ আচমকা চমকান ঘোষের পো-ভাবেন,হায়,হায়,কোথায় রইলো আমার প্রীতিপদের চাঁদ শ্রাবণ মাসটায় হল অস্তমিত ৷ ঘোষের পো এখন চলেছে ঘড়ির বশে-ওঠ বললে ওঠে,বোস বললে বসে,খা বললে খাওয়া চোকায়,শো বললে শোয়া হয় খাটিয়াতে আলসে ৷ ঘোষের পো- তে ঘোষালের পো-তে মাঝে মাঝে ঘড়িটা নিয়ে কথা হয় ৷ ঘোষালের পো বলে ঘড়িটাতে তাহলে তোমার ভুতপুর্বার আত্নাপুরুষ ঢুকেছে নিশ্চয়-ওটারে আর ঘরে নয় ৷ ঘোষের পো বলে,ইস্তির পুরুষ আত্না,এটা কি কথা একটা-থাক ঘড়ি বেচার কথাবার্তা ৷ ও সেই থাক ঘড়ির ভিতর-বিক্রয়ের নামও ওর সামনে আর কথা নয় ৷ তাঁতির পো,হাজরা পাড়ায় তার বাড়ি,বুনে আনলে শাড়ি গুলবাহারি,শুনলে এসে অশুভ খবর শাড়ি যে পরবে সে-ই নাই ৷ বললে,তবে ফিরে যাই ৷ ঘোষের পো বললে,তা কি হয় ভাই ? বায়নার শাড়ি নেওয়াই চাই,রেখে যাও ঐ ঘড়িটার পর ৷ তাঁতির মুখে শুনলে ঘোষজা,এ শাড়ির যোগ্য আছে একটি কন্যা,রুপেগুনে ধন্যা,হাজরা পাড়ার দিলু পাচ্ছে না তার যোগ্য বর-সেই মেয়ে এলে পূর্ণ হয় গোবিন্দ গোয়ালার শূণ্য ঘর,বংশটা ও থাকে বজায় ৷ ঘোষজা বললে,সে আমার অজানা নেই ৷ তাঁতি বললে,মেয়েটা নয় ফেলনা,বলে গেলাম যা ভেবে দেখো,সুখে করবে ঘর-কন্না ৷ হাটে এমো-কাঠের জানলা কিনতে এখন আমি যাই ৷ তাঁতি গেল জানলা কিনতে,তখন ঘড়ি বললে,বেলা তিনটে,ঘোষজা বসে করে চিন্তে-গাই কিনতে গো- হাটে যাই,না দিনটা দেখে হাজরা পাড়ার মাঠ বাগে আগাই ৷ ডাকের মন্তর,কাক চরিত্তর দেখে ঘোষের পোর যাত্রা করতে স্থির,বড় কাঁটা দাদাশ্বশুরের ঘড়ির ঘুরলো আড়াই পাক,ছোট কাঁটাকে দু-ঘর ঠেলে দিয়ে টিকটিক করলো যেন হয়ে আস্থির ৷সে দিকে দৃষ্টি না দিয়েই,লাল সুতো হাতে বেঁধে একখেই,খসখসের আতর বেশ করে মেখে,ফস করে চাবি দিয়ে দোরে,দিলু হাজরার জামাই হতে মানস করে,পা চালিয়ে সজোরে ঘোষজা হল বাহির ৷ সামলাতে পারলে না-তাড়ির দোকানে খোঁজ করতে বসে গেল একখানা গরুর গাড়ির ৷ দলে ভিড়ে গান ধরলে-

‘ ‘গরু গাড়ি চাকায় চলে

গাছের আগায় তাল ধরে

সে গাছে আছে তাড়ি ৷

টাল মাটাল করবি কত

কাল রে মন ভারি

না হলে চলো না শ্বশুর-বাড়ি ৷

সুয্যি ডুবলো;চন্দর ডুবলো,

শেয়ালে তুললো রোল ৷

বোল হরিবোল;ভাঁড়ের তলা শুকনো খালি ৷

ওরে গরু বুদ্ধি সরু তোর

নিত্যি কাট জাবোর

আমি চলি ঝট শ্বশুর-বাড়ি,আছে পা-গাড়ি ৷’’

আকাশে তখন দোয়াদশীর চাঁদ আলো দিচ্ছে চনচন-পাঁচকোশি মাঠ ভেঙে ঘোষের পো চলছে বেগে,হাজরা-পাড়া তেগে ষাঁড় ছুটেছে যেন হনহন ৷ থেকে থেকে দেখছে ঘাড়তুলি-এই লাগছে গো ধুলি ঠিক আর একটা পাকা দেখার দিনের মতন,কাছেই দেখছে যেন হাজরা পাড়ার সাঁজের পিদুম,তুলসী তলায় মাথার উপর চাঁদটা যখন ৷ নিশুত রাত,মাঠের শেষ না পাই,ভুত পেরেতের ভয় নেই,চলছে তো চলছে একলাই গোবিন্দ ঘোষের আধা বয়সী নাত-জামাই ৷ ভাবেতে তন্মন –ভাবছে ঠিক চলছে পথ চিনি একাই ! এমন সময় টিং টিং টিং ওকি শুনতে পাই-যেন দাদা শ্বশুরের ঘড়ি বাজলো টং টং ! ঘোষের পোর মুখ বিবর্ণ,ঘাড়ের সাথে ফিরলো কর্ণ, গো- ধুলির গোলাপী বর্ণ, কোথাও তার চিহ্নও আর নাই ৷ গা-হাত-পা ঝিন ঝিন,মন বললো,এটা রাত না দিন ? পিছনে শব্দ পায় টুপ টাপ ঘুট-ঘাট—যেন কাঠের খরম পায়ে হাঁটছে কেউ ভেঙে মাঠ;নিয়ে তারি পাছ ৷ আর কোথা আছে ! ঘোষের পোর ঘামে ভিজলো আতর মাথা মেরজাই ফিনফিন ৷ কে- রে! বলে দৌড় তো দৌড়,দড়া-ছেঁড়া গরুর দৌড় ! টুক-টাক ঘুট-ঘাট ছুটছে যেন গরুর পাছে গামলাটায় দিতে জাব ৷ তেপান্তর মাঠ জুড়ে শব্দ ! ভুতের চক্করে ঘুরে ঘোষজার শৌখিন প্রাণ হয়রান হল যা এমন হয়নি কোনদিন ৷ তাতারস ছিল ঘোষের পোর ধাতে যথেষ্ট জমা ৷ তাই ছুট দিতে সে ডাইনে-বাঁয়ে হেললো বটে,এললো না ৷লাফিয়ে হলো পগার পার,মাড়িয়ে চললো ঝোপ-ঝাড় ৷পিছন বাগে তার খড়ম পায়ের খট-খট চলার শব্দের তথাপি নেই ক্ষমা ৷ কোথা থেকে আসে শব্দটা,মাটি থেকে,না আকাশ থেকে,না আশপাশ থেকে কে বা দিচ্ছে,কীসের বা শব্দ ওটা! না গাড়ি চলার,না গরু চলার,না ঘোড়া ছোটার,ভাঁটা গড়াবার,নামও নাই থামবার ৷ শব্দটার কিনারা করে কে মাঠের মধ্যে,এ রাতেতে সাধ্য আছে কার ? ভুতের আড়ায় বহুদুর ছুটে জেরবার,চকিতে ফিরে দেখলো একবার ! পা চলল না আর ঘোষের পো দাঁড়িয়ে গেল থ ৷ মুখে নাই রা-এ যে পা পেয়ে দৌড়েছে দাদাশ্ব্শুরের দাঁড়া ঘড়িটা বিদঘুটে ৷ সেই সময় চাঁদের আলো বারালো মেঘ ফুটে ৷ দাদাশ্বশুরের ঘড়ি দেখালে গোলাকার মুখটার ডৌল ৷ চাঁদমুখটি যেন তার খিটখিটে বৌ-র ৷ গুলবাহারি শাড়ির ঘোমটা- দুটো কালো চোখ পুট-পুটে ! বস আর দেখা নয়-ঘোষের তনয় দে দৌড় যারে কয় নিজ বাড়ির মুখে ঘরে ঢুকে কি শুনেছে টিং টিং টিং টিং টিং-দাদা-শ্বশুরের ঘড়ি বলছে-হয় হয় দিন-বাজছে পাঁচটা,চেয়ে দেখ দেখিন-গোলে যাও-টিং টিং টিং ৷ ভৈরব দেয়ান খায় প্রতিদিন দেয়ান খায় প্রতিদিন হিঞ্চের রস এক কাঁচ্চা কাঁচা দুধে,জানতো সক্কালে উঠে !!

পুঁটেরানীরমঠ দুপুলিয়ার পুঁটেরানী দাহ হলেন যে আঘাটায়,সেখানে উঠলো কালীবাড়ি ৷পুজারী হলেন ঘোর শাক্ত ঘাট-বামন শ্যামাচরণ নাম ৷ ইস্টেটের বরাদ্দ মাসিক পাঁচ টাকা-শ্যামাচরণ সংসারে একা,তাতেই ইষ্টদেবতার ভোগরাগাদি সামলে চালান ৷ সেদিন ভৈরব দেয়ান শ্যামাচরনকে ডেকে সমঝান-মায়ের সেবা তো যথাসাধ্য করছো,মঠ-বাড়ির সৈষ্ঠব বাড়ছে কই?শুনি তো কেবল বসে বসে পড়ছো তন্ত্রের বই,মঠবাড়ি যে সুনসান, অথচ বাড়াতে বলছো মাসিক বারদ্দ ৷ শ্যামাচরণ বলেন,আজ্ঞে আমি তো আছি চিরবাধ্য ৷ দেব-সেবার ত্রুটি হয় না, অতিথি জমা হয়-যদি রয় মদ্য-মাংস,নবান্ন,উত্তম ঘৃত,মিষ্টান্নাদি সুখাদ্য ৷ বলেন ভৈরব দেয়ান,অতি সিয়ান- ও কথা দাও ছাড়ান,আমি ভাবছি এক,তুমি ভাবছো আর ! আমি চাচ্ছি মঠ বাড়ির সৈষ্ঠব, তুমি চাচ্ছো কাগ-চিল অতিথ সব ইস্টেটের অন্নধ্বংস করুগ গবাগব ৷ তোমার মত বেকুব দেখি নাই এমন,তোমারে বোঝায় কার সাধ্য ৷ শ্যামাচরণ বলেন,উপদেশ কন,পালন করতে প্রস্তুত এ দাস চিরবাধ্য ৷ উপদেশ হল,এই আদ্যনাথকে কর তোমার চেলা ৷ তুমি তো কবে আছ কবে নেই ৷ তোমার অবর্তমানে যাতে সকল কাজের ধরতে পারে খেই,বর্তমানে পুজো-আস্রাদির কাজে বালকটাকে পাকা-পোক্ত করে তোল এই বেলা ৷ যাও,বারে বারে দরখাস্ত করে ব্রক্ত করো না আমায় ৷ বিনা বাক্য ব্যয়ে উপদেশ লয়ে বিদায় হয়ে গেলেন শ্যামাচরণ চিরবাদ্য ৷ মঠের কাজে ভর্তি করলেন আদ্যনাথে দেয়ান,তার মা ছিল তাঁর বেয়ান ৷ আদ্যনাথের মাছের মতো নিপলক গোল দুটো চক্ষু, বালকটা যেন একটা তরক্ষু,বুদ্ধি সুক্ষু,অথচ দেখে মনে হয় একেবারেই নয় সেয়ান ৷ শ্যামাচরনের সাথে ঘটি গামছা হাতে কোমরে জড়িয়ে পৈতা খান ৷ অটব্য অরণ্য এঁদো-পুকুর,ভাঙা ঘাট, তিনি ফুকুরে দালানে মুক্ত-কেশী দেবীর পাট,তারি উত্তরে সাধন কুটিরে স্থান পেলেন শ্যামাচরণের চেলা বাবা আদ্যনাথ ! শুরুর কাছে নিয়ে দীক্ষামন্ত্র,শিক্ষা করেন চেলা নানা তন্ত্র পূজাপাঠ ৷ কারন করা তান্ত্রিক মতে,পাঁঠার মুড়োটা আসটা করে চাট ৷ পরিপক্ক হতে দেরী করলে না মঠাধ্যক্ষের কাজে ভটচায় শ্যামাচরনের চেলা আদ্যনাথ ৷ ইতিমধ্যে এক রাতে,মঠের সৈষ্ঠব হয় যাতে,চেলার সাথে যুক্তি করেন চিরবাধ্য শ্যামাচরণ ৷ করে দেখলে হয় না কুবরী মন্ত্রে কুবের সাধন ? আদ্যনাথ গুরুরে কন ৷ গুরু বললেন,কথাটা ঠিক, কিন্তু নকুল কুলার্ণবে লিখছে শক্তি বিনা এ সাধনের ফল অনিশ্চিত ৷ আদ্যনাথ বললেন,বুদ্ধি শক্তি তো আছে- অন্য শক্তির কিং প্রয়োজন ৷ তিন আঙুলে নকুলেশ্বর মুদ্রা দেখিয়ে জানিয়ে দিলেন চেলাকে শ্যামাচরণ ক্লিং মন্তর জপের কালে সোনার একটি সজীব প্রমান নেউলের আছে প্রয়োজন-সেটা মেলাই শক্ত বাপধন ৷ আদ্যনাথের নিপলক ভাঁটা চোখে জেগে-জেগে পড়লো সেই প্রথম সেই দিন রাত তিনটাতে ৷ বেজীব আওয়াজে ঘুম ভেঙে দেখে পুকুর ঘাটে পড়ে আছেন সর্ব অঙ্গ হিম,তিন আঙুলে নকুল মুদ্রা- ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র চিরবাধ্য মুক্তকেশীর মঠাধ্যক্ষ শ্যামাচরণ ৷ বেয়ানের মুখে ভৈরব দেয়ান শুনলেন শ্যামাচরনের হয়েছে তিরোভাব ! গোঁফ মুচড়ে দেয়ান বললেন,যাক চুকলো উত্পাত ৷ এখন যা করেন আদ্যনাথ- বলেই দেয়ান নস্য নিলেন একটিপ ৷ তদারকে গেলেন পেশকার-দেবতার সম্পত্তি যেখানকার যা রেখে গেছেন কিনা ভুতপুর্ব শ্যামাচরণ ৷ পেশকার দেখে এলেন সব আছে কেবল নাই পূজারীর সেরাচীন বাঘাসন ৷ কুন্তি বুড়ি নিযুক্ত হল সেই দিন থেকে মঠ বাড়ির খোন্তা খুন্তি ইত্যাদি করতে মার্জন ৷ আশ্বিন গেল,পড়তে কার্তিক ঝাঁজ শেওলা সিঁদুর গোলা যেন দেখাচ্ছে ঠিক ৷ ঘাটে বসে কুন্তি বুড়ি পিতলের খুন্তি হাতা কসে মাজছে,ঘসে ঝামা ইঁট ৷ হেন কালে ঘাটের রানা হতে কুড়ি হাত অন্তরে পড়লো বুড়ির নজরে,ভুস করে উঠলো,ঝুপ করে ডুবলো,মা বলে দিয়ে ডাক,ড্যাব-ড্যাবে চোখ বোয়াল মাছ ৷ এমনি একবার নয় তিনবার ! ঠেলে শেওলা ঝাঁক,মা গো মা, বলে দিয়ে আবাজ মাছ উঠলো আর ডুবলো আকাশে তুলে লেজের দিক ৷ পুকুর ঘাটের খবর যেমন হয়ে থাকে বরাবর হওয়াতে পৌঁছাল বাজারে হাটে ৷ পাটরানী শুনলেন কুন্তির মার কাছে ৷ রাজা শুনলেন রানীর মারফতে-পুঁটেরানীর পুকুরে পুঁটিমাছ মা মা বলে শ্যামা বিষয় গাইচে বসে ঘাটে ৷ পেশকার বললেন,দেওয়ানজী, শুনছেন কি ব্যাপার ? রানীর পুকুরে জলহস্তী একটা শ্যামা সঙ্গীত শোনাতে আদেশ পেয়ে গেছে শ্যামা মার ৷ হুম,বলে গোঁফ মোচড়ালেন ভৈরব দেয়ান দু-চারবার,জবাব দিলেন না কোন প্রকার ৷ পাটরানীর হুকুম হল যখন ভাঙাঘাট সারিয়ে শ্বেত পাথর লাগাতে,দেয়ান বুঝলেন আদ্যনাথ মঠবাড়ির সৈষ্ঠবের কাজ নিয়েছেন হাতে ৷ কুন্তির মা শুধায় আদ্যনাথকে,হ্যাঁ বাবা, কুন্তি তো কানে কালা,কেমন করে শুনলে,মা বলছে মাছে? আদ্যনাথ বলেন,কি না হয় মায়ের কৃপাতে,মাছে কয় কথা,শুনতে পায় কালাতে ৷ যা হোক ঐ সব দৈব বলতে মানা যার তার কাছে,বুঝেছ কুন্তির মা ৷ কুন্তির মা বলে,কুন্তি আমার অত শত বোঝে না ৷আদ্যনাথ বলেন,তা বললে কি চলে ? শ্রীমন্তের বাপের মশাল হয়েছিল সিংহলে কমলে-কামিনী দেখার কথা বলে- সেটা জানা আছে ৷ কুন্তি যে কালা সে কালাই রইলো ৷ কুন্তির মার কাছে হিমী,বামী শৈল শুনলে কমলে-কামিনী পুকুরের মাঝে উঠেছে আর গিলেছে জলহস্তী ৷ রাষ্ট্র হল কথাটা বাজার বস্তি-লোকের আনাগোনায় হাঁটাপথ মঠের দিকে অল্পদিনে ৷ প্রস্তত হল তিন বিতস্তি ৷ ইতিমধ্যে খুন্তির মেলা বসাতে দেয়ানের বাসাতে পাঁজি হাতে আদ্যনাথের উদয় ৷ দেয়ান কইলেন,আর দেরী নয়,আগামী ভুত-চতুর্দশী উপযুক্ত সময় ৷ তেল পিদুম ইত্যাদির খরচা সিষ্ঠবের কারণ ছেংছন করলেন স্বয়ং ভৈরব দেয়ান মহাশয় ৷



দেয়ানের চটি

ভেড়ির চরে দুপুলিয়ার পুরোনো গড়ে ভেঙে-পড়া খোয়াব-গা সেখানে বাস করে রাজার মুচি,সেলাই করে বিবিরানীর কিংখাবেব পা-পুস আর সোনার তারের ফোঁড় দিয়ে হরিনের চামে রাজার লপেটা ৷ এমাসটায় দেওয়ানজীর হয়েছে ফরমাশ খটাশের চামে খালাষি-চটি-সেটি হলেই বেড়ে যায় ভাতা ৷ মুচির শ্বশুর চামার,তারে শুধাতে দর চামড়ার,চামার-গুষ্টি রুখে উঠলো করে মার মার ৷ বলে,দূর দূর কোথাকার মুচি তুই,চামারে করে না ও চামের করবার; জামাই বলে পেয়ে গেলি পার ৷ শাশুরী বললে,বাছা,খট্টাঙ্গ রাজার ঘোড়া-নাম কোরো না চাম ছাড়বার,মেয়ে মরে যাবে আমার ৷ মুচির ঘেসেড়া-পিসি ঘোড়ার ঘাস কাটে ভেড়ি-চরার মাঠে,তাকে শুধালে খটাশের কথা মুচি ৷ সে বললে,শুনেছি যা চলে খটাস খটাস তাকেই বলে খটাশ ৷ চামার শ্বশুরের কাছে ঘোড়ার চাম কেনো গো দরদাম বুঝি ৷ সব ঘোড়াই খটাঙ্গ রাজার বুঝে শ্বশুরবাড়ির নামে ভড়কালো মুচির পো ৷ খাটুলিতে শুয়ে ভাবছে খালাষি-চটির কথা;নিশুত হল খোয়াব-গা,মেঘেতে মিলালো চাঁদের ছটা ৷ রাত নিশুতি,শুনলে মুচি শব্দ খটাখট সুস্পষ্ট ৷ বুকের মধ্যে করলে অনুভব নী;শ্বাসের কষ্ট ৷ তারপরেই চোখ চেয়ে খাটের খুরোর মত অষ্ট আশি বছরের দেড়ে এক বুড়োকে আঙুল নেড়ে ডাকতে দেখলে পষ্ট ৷ গায়ে তার পাতলা চাদর-যেন এই ছেড়ে উঠেছে পাতাল হতে ঠেলে মাটি আর কাঁকর ৷ মাথা-ভর ধুলো মাখা জটা ৷ মেঘ কেটে তখন প্রকাশ পেয়েছে চাঁদের ঘটা ৷ বন্ধ ঘর ছেড়ে বার হল মুচি,বুড়োর ইঙ্গিত বুঝি,চামকাটা বাটালিখান কোমরে গুঁজি ৷ লন্ঠনটা নেবার পেল না সময়,ঘাম দিচ্ছে গা-ময় ৷ বুড়ো উঠে চললো খোয়াব-গা’র চাল-চুলো পড়া পাঁচতালা চিলে কোঠার দিকে,চলে এসো জানায়ে ইঙ্গিতে ৷ মুচি চললো, কলের পুতুল যেন উঠি,পড়লো কিনা পড়লো তার পা ধাপ ধ্বসা টালি ভাঙা ঘুরোনো সিঁড়িতে-চাঁদনীতে তখন মিট মিট পিদুমের অধিক আলো নয় ৷ পেঁচা না করে চেঁচামেচি ঘেঁচি-কড়ির মতো একটা চোখ মটকালে বসে পাঁচতলার ফাটা দেয়ালে ৷ মুচির মনে হলো,আনলে হত ভালো একটা লন্ঠন,সিঁড়ি ভেঙে কোমরটাও করছে টনটন,বুড়া ঠিক চলছে তখনো এগিয়ে হনহন ৷ পেরিয়ে ছাতের পর ছাত,ওঠাল নামাল সিঁড়ির ধাপ,অলিগলি,ভাঙা দোর ঘুলঘুলি,ঢুকেই একটা গোল ঘরে হওয়ার পরে ধূমার মতো পাক খেয়ে ফিরে দাঁড়াল বুড়ো ৷ মুচি দেখলে সামনে পড়ে খটাশে চাম ঘরখান জুড়ে যেন সতরঞ্চ একখান ৷ ইঙ্গিতে বুড়ো জানান দিলে,কাটো চাম রাতারাতি ! বাটালি চালাতে বসে গেল মুচি কসে মুঠিয়ে ধরে কাঠের ডাঁটি ৷ চামের পরে চোপ বসাতেই,ওপ বলে যেন তোপে উড়ে গেল বুড়ো ঝুলের মতো ৷ যেন মাকড়সার জালে আটকানো রইল তার কাপড়-চোপড়গুলো ৷ ঠিক সেই কালে কানাচের আড়ালে খুন-খুন বলছে,কানে শুনলো মুচি-চক্ষু বুজি লেপ মুড়ি দিয়ে শুলো ৷ সকালে পোষা নুলো বেড়াল মেঁও মেঁও শব্দে তারে জাগালে ৷ মুচি উঠে দেখে নিজের যন্তর-পাতি রাখা চামের বড় থলিটাকে বাটালি চালিয়ে খালাষি-জুতোর আকারে কেটে রেখেছে খটাশের চামড়ার খোয়াবে খেয়ালে ৷ ভাবে তখন রাজার মুচি খালাষি-চটির গোড়ালি বাঁধাবো কি গাধার নালে ৷

ছিটওয়ালা কাক

ছিটওয়ালা রাজার পোষা দাঁড়কাক খানা-কামরার ঘুলঘুলিতে থাকে ৷ রাজার গোয়াল রোজ এক গোলা মাখম,দু-গুলি পনির খাওয়ায় পরের চেকনাই বাড়ে যাতে ৷ গুরুমশাই পড়ান রোজই তাকে ক’য়ে আকার কা খ’য়ে আকার খা ৷ সে পড়ে ক কা কাক বক,বসে খানা-কামরার বারান্দায় ৷ এর বেসী পড়ায় পারলে না আগাতে ৷ কিন্তু স্বভাব-চতুর কাক,পড়ে বা কোনদিন,এমনি দেখায় ভাব সভাব সাক্ষাতে ! রাজার চিহ্নিত কাক ঠোকর বসালে টাকে,সভা-পন্ডিত হেসে কিঞ্চিৎ-একচক্ষুর্নকাকোয়ং- বলে উদ্ভট একটা কাক-প্রশস্তি চট শুনায়ে দেন রাজাকে ৷ রাজা হন তুষ্ট,কাকও হন হৃদপুষ্ট ৷ তস্মিন তুষ্টে জগৎ তুষ্ট-জেনে নিল সচতুর পন্ডিত দুপুর বেলা কৃষ্টনাম পড়াতে দুপুলিয়ার কাকে ৷ কাক তো নয়, দুপুরিয়া ডাকাত-একথা বললে রানীর চাকরানী ৷ পন্ডিতানী বলেন-ও কথা বলতে নেই ৷ আমাদের তিনি বলেছেন,ও কাক নয়,এক-এক খগোমানী ৷ মেথরানী যদি বলে-এক চোখোরে ঝাড়ু মার,ঝাড়দার বলে,কাকের ঠোকরে হলি বলে কানী ৷ ওকথা তুলিসনে আর ৷ ভৈরব দেয়ান একদিন বলেন,ওহে পেশকার,কাক চরিত্র অতি বিচিত্র-একখানা দেখো পেশকার বলেন,কাল থেকে চশমাখানা খুঁজে পাচ্ছি না আমার ৷ এমনি প্রতিদিন কারো না কারো কিছু না কিছু হারায় ৷ কুটোটি এদিক ওদিক হতো না যে দুপুলিয়ায় সেখানে রোজই হারায় এটা-ওটা ৷ গালা-মোহর করতে মুহুরী পায় না বাতির টোটা ! বলে,এই ছিল মশায়,এই নেই ! দপ্তরী দেখে,খুরি-সুদ্ধ উধাও লেই ৷ দেয়ানজীর ধমকের চোটে চাকর-নফর কারো মনে সুখ নেই ৷ বাটি-চালা ডাকে,ঘটি-চালা ডাকে,পয়সা চলে,কড়ি চলে ধরতে চোরটাকে ৷ চাল-পড়া খেয়ে শুধু নিজেদেরই গলা শুকোয়,জিভ হয় মোটা ৷ সেই সময় কাছারি বাড়ি ফাটালে চিত্কারে রামদুলুলী-চানের বেলায় চুরি গেছে তার হাঁপানির মাদুলি ! দপ্তরীর দুর্বুদ্ধি হল,বললে-কেন চেঁচাস,শিষের মাদুলি গেছে যাক-গলায় বেঁধে রাখ একটা কালী-ছোপা চুনের পুঁটুলি ৷ এই না,হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে আঙিনাতে শাপ-শাপন্তি সুরু করলে রামদুলুলী-

‘’মরুক মরুক কেকো মরুক

মাথার কেশ উকুনে কুরুক

ঘুমিয়ে জেগে ঘুরুক মাথা

বুকে ঠেলা দিক আগুনি ভাঁটা

বল কে খেলি জনায়ের মাদুলি

বার কর হেঁচে-হেঁচে হিক্কে তুলি ৷

নয়তো মর হেসে হেসে,খেতে খেতে

শুতে শুতে,বসতে,হাঁটতে,দাঁড়াতে উঠে ৷

মরুক না মরুক,হাঁপ তো ধরুক !

আমার মাদুলি বন্দুকের গুলি

গুলগুলি হয়ে গলায় ফুটুক- ’’

কারকুন বলে,রামদুলুলী হও শান্ত ৷ রাজবাড়ির মধ্যে শাপ-শাপন্তি কর কেন ? আর কেন?লাঠি ঠুকে উঠলো যেন নেচে ডাইনী বুড়ী রামদুলারী –চললো ছড়া কেটে-

‘জনায়ের গোঁসায়ের মন্তর

কই কাটাক দেখি পারে কোন চোর !

চোর বলে চোর,মাদুলি চোর,

মাদুলি বলে মাদুলি-

হাঁপের মাদুলি-মন্তর মন্তর ৷

খুললো খুললো বলে যমের দোর

লাগলো লাগলো বলে দোক্তার ঘোর

তুললো তুললো বলে অসুধ

এলো এলো বলে যমের দূত!’’

হেনকালে ঘটলো কান্ড অবাক-যমদূত না এলো, এলো একটা ঝড়ো ডোম কাক !কে বলবে সেটারে দেখে ছিতয়ালা দুপুলিয়ার রাজার পোষ্য !সে কাশলে,কেশোরুগী যেন নিয়েছে লস্য-খাক খাক খাৎ! গলা চিরে তামার মাদুলিটা মাটিতে পড়লো খটাৎ ৷ রাজার বড় খানসামা বলে উঠলো-আপদের শান্তি যাক ৷ কাকটা করেছে কুখাদ্য হজম অনেকগুলি ৷ শোধন করে করগা ধারণ মাদুলি,বুঝলে তো রামদুলুলী ৷



গুমগুমি

বাজার দুপুলিয়ায় গুমগুমি এয়েছে-উঠলো রব ! ঘরে বাজারে ডরে মরে লোক,বলে ,কে এলোরে বাবা,বাঘের ঘরে ঘোগ-সেটা গোটা ধরে আর থলিতে ভরে,কপালে টেনে নিয়ে চুনের তেলোক ৷ বাড়ি নিয়ে খেয়ে ফেলায় গব-গব ৷ শখের দলের অধিকারী,-বেশ একটু ওজনে ভারী ৷ সে দেনার দায়ে সরে পড়লো-গুমগুমিতে পেয়েছে বাজারে রটলো ৷ প্রবোধ সুবোধ ভালো দুটো ছেলে,বিয়ে হতো আজ কি কাল গেলে-হঠাৎ নিলে সন্ন্যাস ৷ বাজারে রটলো,গুমিতে ধরেছে,আর কি ব্যাস ৷ বিন্দাবনে গেল দুপুলিয়ার কীর্তনিয়া,পাষান গলতো যার মাথুর শুনিয়া-বাজারে রটলো গুমিতে তারে গেল নিয়া ৷ ফজলু সহিসের দুম্বাটা বকরিদের আগেই পালালো-গুমিতে নিয়েছে বাজারে রটলো ৷ গো-বদ্যি সে বদ্যিনাথে গেল সুদখোরের তাড়ায়-গুমিতে নিয়েছে সত্যি সত্যি রটলো পাড়ায় ৷ গুমির ভয়ে রাত না হতে,বন্ধ হয় দোকান-পাট,খোলা রয় না দোর-জানলা-কপাট সুনসান হাট বাট,কার কারবার,লোক চলাচল সব বন্ধ ৷ দেয়ান বলেন,পেশকার ব্যাপার কি বুঝছো ? পেশকার বলেন বুঝছি পরিস্কার ? ব্যাপার টা নয় তুচ্ছ ৷ দেয়ান বলেন,রটনার মধ্যে আছে সত্য মিথ্যা কতকটা উহ্য ? সেদিন পহর রাতে,লোকজন নাই হাটে,ভৈরব দেয়ান একা যান গুমগুমির তল্লাসে গুপ্তি হাতে ৷ টাকের পরে ক্ল্কাদার চামড়ার কাপু,কোমরবন্ধে কলম-কাটা চাকু,সর্বাঙ্গ ঢাকা কলন্দরি আলখাল্লাতে ৷ দুপুলিয়ার কেল্লার বাইরে শ্মশান ঘাট,মাঠের মাঝে খাড়া আছে একটা মুড়ো খেজুর গাছ ৷ শকুনি কটা চুনের পৌচড়া টেনেছে তাতে,জন মানবের নাই যাতায়াত সে তল্লাটে ! দেয়ান প্রথমে যান বাজার ঘুরে হেঁকে-মুশকিল আসান! সাড়া শব্দ নাই কারো,চকর বাজার সুনসান ৷ পহরা কি প্রহরি,কারো দেখা নেই ও হরি গেরস্তো পাড়া,আছে নি:সাড়া গুমির ভয়ে বেরোবার নেই নাম ৷ একাই আগান দোকান-পাট পারিয়ে মাঠের দিকে ভৈরব দেয়ান ৷ আকাশে তখন নাই চাঁদ,খেজুর তলে এক মূর্তি দেখা দিল হঠাৎ-কালো মুস্কো- চটের থলির পাশে বসে আছে চুলগুলো উস্কো-খুস্কো যেন যমদূত সাক্ষাৎ ৷ কে রে ! বলে দেয়ান ছাড়লেন এক কোতোয়ালী হাঁক ৷ মূর্তিটা যেন কালো দত্যি,উঠে দাঁড়ালো রাতের আলোয় যেন দেখালো দুপুরিয়া ডাকাত বুক চটালো ৷ ভৈরব দেয়ান, তিনি নন কম শক্তিমান-কচি ছেলে নন একরত্তি-মুঠিয়ে ধরেন গুপ্তি ভাবেন,দেখা যাক গুমি কিনা সত্যি ! মূর্তিটা চটের থলিটা তুলে ঘাড়ে,আগাতে চায় মাঠের পারে ৷ কে রে যাস ! দেয়ান বলেন তারে ৷ লোকটা যেন শুনেও শোনে না,চেহারাটা একেবারে অচেনা ৷ দেয়ান বলেন,দেখছো বাপু কলন্দর আমি মাথায় কাপু –একা পড়েছি মাঠে, একটু দাঁড়াও, যাই একসাথে ৷ মূর্তি বলে দাঁড়াবার সময় নেই ৷ সুর্যোদয়ের আগে ভুতের বোঝা নামাতে হবেই ৷ রোদের ভয়ে চলাচলি করি রাতে দামী মাল আছে আমার বোঝাতে ৷ সোজা কইবোই,বই ভুতের বোঝা ৷ উটের পিঠে যেন কুঁজের বোঝা ৷ কথাটা কইতে সোজা,বোঝাটা বইতে সোজা নয় ৷ এই বলে আর মূর্তি অগ্রসর হয় ৷ দেয়ান ভাবেন,এই সেই গুমি নিশ্চয় গেছে বোঝা ৷ আগে চলে চট থলি ঘাড়ে কালো মূর্তি ৷ দেয়ান চলেন হটহট চালে হাতে ধরে গুপ্তি ৷ খোয়ারের বাঁকে স্থানটা অন্ধকার,দেয়ান সেই ফাঁকে থলিতে বসান চাকু আপনার ৷ মাটিতে প’লো থলি-ছিড়ে শির যেন গোটা পাঁচ ছয় ৷ দেয়ান বলেন,এ কিরে ? লোকটা বললে,কি করলে মশায়? বৈতাল কুমড়ো কটা হল নয় ছয় ৷ এ সব বস্তু রাজা রাজোড়ার রাজভোগ, যোগাড় করতে ভুগতে হয় ভোগ ৷গুমি বলে কত লোক মার দিয়েছে মশায় ৷ আগাগোড়া বরবাদ করলে এখন কি হয় ? দেয়ান বলেন,বোঝা গেছে,যা গেছে তা গেছে,আমার কাছে যাদুবিদ্যা খাটবার নয় ৷ দেখা যাবে সকালে কাল বৈতাল কুমড়ো কোন গাছে ফলায় ৷ সরে পড়ো ভালো চাও তো-আমি ভৈরব দেয়ান সেটা জান তো ? ও কথা আর উচ্চবাচ্য নয় ৷ দুপুলিয়ার রাজা হিঁদূর চুড়ো,বৈতাল কুমড়ো খাবার পাত্র নয় ৷ বিদায় হও,নিয়ে টাকা পাঁচ ছয় ৷ মুশকিল বাধবে সকালে কালকে কুষ্মাণ্ড যদি নরমুণ্ড হয় ৷ ভুতের বোঝা বহে এলে এবার প্রাণ-সংশয় ! ঘাল হয়েছে গুম্গুমি-সকালে পেটান দুমদুমি দুপুলিয়াতে দেয়ানজী মশায় ৷


Comments